৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তিন ভাইয়ের যুদ্ধ জয়ের গল্প

Spread the love

aftab alisad miah1kodhor miahসাইদুল ইসলাম:
এমনই এক বসন্ত ছিল তখন, ছিল উত্তাল সারা দেশ। দুশ্চিন্তা অার উৎকন্ঠায় ছিলেন দেশের সর্বস্তরের জনগন। ঠিক তখনই বাঙ্গালীর ভাগ্যে নেমে এল ২৫ শে মার্চের কালো রাত। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোষররা বর্বরতার মহোৎসব চালালো সেদিন। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষনার সাথে সাথে স্বাধীনতাকামী জনতা ঝাপিয়ে পড়েন মুক্তি সংগ্রামে। লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের মত দেশকে স্বাধীন করার নেশায় পেয়ে বসল সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নের দক্ষিণভাগ গ্রামের মো: ইদ্রিস অালী ও জোবেদা খানমের চার পুত্র সন্তানের তিনজনকেই। বড় ভাই অাফতাব আলী, দ্বিতীয় ভাই সাদ মিয়া ও কনিষ্ঠ ভাই কদর মিয়া দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঝাপিয়ে পড়েন মুক্তি সংগ্রামে। অার তৃতীয় ভাই খালিক মিয়া বাড়িতে থেকে গেলেন মা-বাবাকে দেখা শোনার দায়িত্বে।
বড় ভাই আফতাব অালী ভাদেশ্বর নাসীরউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় থেকে এস এস সি পাস করে ১৯৪৮ সালে সিপাহী পদে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে তিনি সৈয়দপুর সেনানিবাসে হাবিলদার পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি ছিলেন 2MF কোম্পানি কমান্ডার। মার্চ মাসে তাঁর কোম্পানি পলাশবাড়ীতে অবস্থান করছিল। যুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে অাফতাব অালী তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেলটা কোম্পানির একাংশ নিয়ে বিদ্রোহ করে বর্তমান গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী থেকে কুড়িগ্রামের রৌমারী চরাঞ্চলে অবস্থান নেন। সেখানে তিনি স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অন্তর্ভুক্ত করেন। অাগস্ট মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত তিনি গোটা রৌমারী অঞ্চল মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। ৪ অাগস্ট পাক বাহিনীর বিরাট একটি দল রৌমারী দখলের উদ্দেশ্যে কোদালকাঠিতে অাক্রমন করে। ব্যাপক অার্টিলারী গোলাবর্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এই সুযোগে পাক সেনারা কোদালকাঠি দখল করে। পাক বাহিনী শক্তিতে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকগুণ। সে জন্য অাফতাব অালী তখনই পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা অাক্রমন না করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কয়েকদিনের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর অারো কয়েকটি দল এসে শক্তি বৃদ্ধি করে। এদিকে পাক বাহিনী কোদালকাঠিতে অবস্থান নিয়ে রৌমারী দখলের চেস্টা করতে থাকে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সে চেস্টা প্রতিহত করতে থাকেন। দু-তিন দিন পর পর সেখানে অনেক যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এসব যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। তাঁর সাহসিকতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রৌমারী দখলের চেস্টা ব্যার্থ হয়ে যায়। দুই দিন তুমুল যুদ্ধের পর পাক বাহিনী কোদালকাঠি অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। এর পর গোটা রৌমারী এলাকা পুরোপুরি মুক্তাঞ্চলে পরিনত হয়। পাক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের কাছে অাফতাব অালী ছিলেন মুর্তিমান অাতঙ্ক। অসংখ্য রাজাকার ও অালবদরকে তিনি প্রকাশ্যে গুলি করে শাস্তি দেন। জীবনের তোয়াক্কা না করে তিনি একের পর এক পাকিস্তানিদের বিপর্যস্ত করে দেন। একবার তাঁর দু পায়ে চারটি গুলি লেগে অাহত হন। সুস্থ হয়ে পুনরায় তিনি যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। দু:সাহসী এই যুদ্ধা কখনো থেমে যাননি। মুক্তিযুদ্ধেরর পুরো সময় স্ত্রী সন্তানদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে দেশের জন্য অদম্য সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন। পুরো রৌমারী অঞ্চল মুক্ত রেখে তিনি কিংবদন্তীর যোদ্ধা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পান এবং তিনিই একমাত্র ব্যাক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধে দুটি রাষ্ট্রীয় খেতাব বীর উত্তম ও বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হোন। ১৯৭৯ সালে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনরারী ক্যাপ্টেন পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।বর্তমানে ৭ সন্তানের জনক অাফতাব অালী ৯৬ বছর বয়সে পরিবার পরিজন কে বিদেশে রেখে দেশের টানে নিজে একা দেশে পড়ে অাছেন। দুই ছেলে তাজুল ইসলাম ও আজিজুল ইসলাম লিটন ও পাঁচ মেয়ে সাহারা আক্তার পারভেজ, বিলকিস আক্তার পারুল, পারভিন অাক্তার, লায়লুন নাহার অাক্তার লাভলী ও নুরজাহান অাক্তার চুটুল। সবাই কানাডা ও ব্রিটেনে স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠত।
দ্বিতীয় ভাই ছাদ মিয়া ১৯৬২ সালে পাকিস্তান পুলিশে হাবিলদার পদে যোগদান করেন। যুদ্ধের সময় তিনি রাজারবাগ পুলিশ লাইনে কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জে চলে যান। সেখানে তিনি স্থানীয় ছাত্র-যুবক-কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অন্তর্ভুক্ত করান। পাক বাহিনীর মোকাবেলায় তিনি কৌশলী যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হোন। স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে তিনি পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাম্পে যেতেন। নিয়মিতভাবে শত্রুবাহিনীর সকল গোপন খবর তিনি মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌছে দিতেন। এসব করতে গিয়ে অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু কোন কিছুকে তোয়াক্কা না করে জীবনের ঝুকি নিয়ে একে একে পাক বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে তোলেন। ২০০২ সালে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী থেকে তিনি অবসরে যান। বর্তমানে সহধর্মিণী সহ তিনি দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে নিজ গ্রামের বাড়িতে বসবাস করছেন।
সদ্য এস এস সি পাশ করা ২২ বছরের টগবগে যুবক ছোট ভাই কদর মিয়া। ১৯৬৯ সালে তিনি ছাত্রলীগ থেকে অাওয়ামীলীগে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রথমে তিনি নিজ এলাকা গোলাপগঞ্জ থেকে ভাদেশ্বর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নোমান মিয়া চৌ:, নজির মিয়া, বতর্মান চেয়ারম্যান ছালিক মিয়া সহ প্রায় তিন থেকে চার শতাধিক মুক্তিযুদ্ধাকে ভারতে পৌছে দেন প্রশিক্ষণের জন্য। বড় ভাই সুবেদার অাফতাব অালীর জন্য মা-বাবা সহ পরিবারের সবাই যখন উদ্বিগ্ন তখন বড় ভাইয়ের খোজ নেয়ার জন্য বেশ কয়েকবার তাকে ভারতে যেতে হয়। শেষ পর্যন্ত বড় ভাইয়ের খোঁজ মেলে কুড়িগ্রামের রৌমারী চরাঞ্চলে। রওয়ানা দেন ভাইয়ের কাছে। ভাইয়ের কাছে পৌছার অাগে ৭ দিন অাটক ছিলেন দিনাজপুর বর্ডারে। বর্ডার থেকে ছাড়া পেয়ে বড় ভাই আফতাব অালীর সাথে দেখা করে ঝাঁপিয়ে পড়েন রনাঙ্গনে। জীবন পন বাজি রেখে তিনি কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন ১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। এক যুদ্ধে তিনিরা ২২ থেকে ২৩ জনের মুক্তি বাহিনীর কাছে ৫০ জনেরও বেশি পাক বাহিনী পরাজিত হয়। পাক বাহিনীর প্রায় সবাইকে তিনিরা হত্যা করেন। যুদ্ধ শেষে তিনিরা যখন মিছিল দিয়ে ফিরছিলেন তখন রাজাকাররা তাঁদের একজনকে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করে। চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত তিনি লড়ে গেছেন দেশের জন্য। বিজয় শেষে প্রায় দেড় মাস পর তিনি বাড়ি ফেরেন। এতক্ষনে পত্রিকায় সংবাদ ছেপেছে তিনি নিখোঁজ। স্বাধীনতার পর তিনি দীর্ঘদিন গোলাপগঞ্জ উপজেলা অাওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া তিনি ৮নং ভাদেশ্বর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের নির্বাচিত ইউপি সদস্য ছিলেন। বর্তমানে স্ত্রী সহ এক ছেলে সুবের অাহমদ এবং দুই মেয়ে শোভা বেগম ও ইভা বেগম কে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে বসবাস করছেন।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে একই পরিবারের তিন ভাইয়ের যুদ্ধে অংশগ্রহন ও বিজয়ী বেশে বাড়ি ফেরা এক অসাধারণ ঘটনা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত। তাঁরা তিন ভাইয়ের যুদ্ধ জয়ের ইতিহাস পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য প্রেরনার উৎস হয়ে থাকবে। চিরদিন তিনিরা অমর হয়ে থাকবেন স্ব মহীমায়, শ্রদ্ধায়, ভালবাসায়।


Spread the love

Leave a Reply