জলবায়ু পরিবর্তন: আইপিসিসি রিপোর্টে ‘মানবতার জন্য কোড রেড’

Spread the love

বাংলা সংলাপ রিপোর্টঃ মানুষের কার্যকলাপ জলবায়ুকে অভূতপূর্ব এবং কখনও কখনও অপরিবর্তনীয় উপায়ে পরিবর্তন করছে, জাতিসংঘের একটি প্রধান বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

ল্যান্ডমার্ক স্টাডি ক্রমবর্ধমান চরম তাপপ্রবাহ, খরা এবং বন্যার বিষয়ে সতর্ক করে, এবং মাত্র এক দশকেরও বেশি সময় ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ তাপমাত্রার সীমা ভেঙে ফেলা হচ্ছে।

রিপোর্টটি “মানবতার জন্য একটি কোড রেড”, জাতিসংঘ প্রধান বলেন।

কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবী দ্রুত কাজ করলে একটি বিপর্যয় এড়ানো যায়।

গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনে গভীর হ্রাস ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রাকে স্থিতিশীল করতে পারে বলে আশা করা যায়।

জাতিসংঘ গঠিত জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) প্রতিবেদন বলছে, পৃথিবীর উষ্ণতা যেভাবে বাড়ছে তাতে চূড়ান্ত বিপদের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে মানবসভ্যতা। আর সেজন্য মানুষই পুরোপুরি দায়ী।

‘নীতিনির্ধারকদের জন্য সারসংক্ষেপ’ শিরোনামে সোমবার প্রকাশিত ৪২ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী দুই দশকের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রাক শিল্পায়ন যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে।

এর মানে হল, ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে উষ্ণায়নকে যে মাত্রায় বেধে রাখার অঙ্গীকার বিশ্বনেতারা করেছিলেন, তা পূরণ করা হয়ত সম্ভব হচ্ছে না।

আর এই উষ্ণতা বৃদ্ধির ফল হবে মারাত্মক। এ শতকের শেষে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা দুই মিটার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনার বিষয়টিকে বিজ্ঞানীরা আর উড়িয়ে দিতে পারছেন না।

তবে ছোট হলেও একটি আশার আলো রয়েছে আইপিসিসির গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিবেদনে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমণ ব্যাপক হারে কমিয়ে আনা গেলে বাড়তে থাকা উষ্ণতায় ভারসাম্য ফিরে আসতে পারে।

কয়েকশ বিশেষজ্ঞের গবেষণা ও সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রায় ৮ বছর ধরে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে আইপিসিসি, যেখানে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের সবশেষ বাস্তব অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৮৮ সাল থেকে আইপিসিসি এমন ছয়টি প্রতিবেদন দিয়েছে।

এবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্রুত জলবায়ু বদলে গিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, মেরু অঞ্চলে বরফ ও হিমবাহ গলে যাওয়া, তাপদাহ, বন্যা আর খরার মত ঘটনা বাড়ছে মানুষের নানা কার্যক্রমের কারণেই।

এ প্রতিবেদনকে মানবজাতির জন্য সর্বোচ্চ সতর্কবার্তা বা ‘কোড রেড’ হিসেবে বর্ণনা করে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জ্বালানি হিসেবে কয়লা এবং উচ্চমাত্রায় দূষণ ঘটানো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যত ্রদুত সম্ভব বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “আমাদের গ্রহটাকে ধ্বংস করে ফেলার আগে এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়েই কয়লা ও ফসিল ফুয়েলের মৃত্যুঘণ্টা বাজানো উচিত।”

১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করে আইপিসিসি। এর উদ্দেশ্য জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন হাজির করা। সরকারগুলোকে বৈজ্ঞানিক তথ্য সরবরাহ করা। তারা রিপোর্টে আস্থার সঙ্গে দৃঢ়তায় বলেছে, দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়, মানুষের প্রভাবে আবহাওয়া, সমুদ্র ও স্থলভাগ উষ্ণ হয়ে উঠেছে। বৃটেনের ইউনিভার্সিটি অব রিডিং-এর প্রফেসর এবং এই রিপোর্টের অন্যতম লেখক এড হকিন্স বলেছেন, এই রিপোর্টে যেসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে তা সত্য। এর চেয়ে বেশি সুনির্দিষ্ট আমরা হতে পারি না। এতে যেসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে তা দ্ব্যর্থহীন এবং অনাপত্তিকর যে, এই গ্রহকে উষ্ণ করে তুলছে মানুষজাতি। ওয়ার্ল্ড মেটেওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের মহাসচিব পেত্তেরি তালাস বলেছেন, খেলাধুলার টার্ম ব্যবহার করে কেউ বলতে পারেন, আবহাওয়ায় ‘ডোপের’ প্রকাশ ঘটেছে। এর অর্থ হলো, আমরা আগের চেয়ে অধিক চরম প্রতিকূলতা দেখতে শুরু করেছি।

এই রিপোর্টে লেখকরা বলেছেন, ১৯৭০ সাল থেকে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা গত ২০০০ বছরের মধ্যে যেকোনো ৫০ বছরের তুলনায় অনেক দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এই উষ্ণতা এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে প্রতিটি অঞ্চলের আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। সম্প্রতি চরম তাপদাহ প্রত্যক্ষ করেছে গ্রিস এবং উত্তর আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চল। বন্যা হয়েছে জার্মানি ও চীনে।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা যা ছিল তার চেয়ে ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এক দশকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ১.০৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৮৫০ সালের পর গত পাঁচ বছর ছিল সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত ছিল পৃথিবী। ১৯০১ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যেটুকু বৃদ্ধি পেয়েছিল তার তিনগুন হয়েছে সম্প্রতি। ১৯৯০এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত হিমবাহ গলার জন্য প্রধানত দায়ী হলো মানুষ। এ জন্য তারা শতকরা ৯০ ভাগ দায়ী। এর ফলে আর্কটিক সাগরের বরফ কমে যাচ্ছে। ফলে এটা এখন কার্যত নির্দিষ্ট যে, তাপদাহসহ উত্তপ্ত চরম অবস্থা ঘন ঘন আঘাত হানছে। ১৯৫০এর দশকের পর তা অনেক বেশি তীব্র হয়েছে। অন্যদিকে শীত সংক্রান্ত ইভেন্ট অনেকটা কমে গেছে এবং তার ভয়াবহতা অনেক কম।

এতে আরো বলা হয়েছে, সমুদ্র আরো উষ্ণ হবে। ফলে সমুদ্র আরো এসিটিক হয়ে উঠবে। দশকের পর দশক অথবা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পাহাড় ও মেরু অঞ্চলের হিমবাহ বা বরফ গলা অব্যাহত থাকবে। প্রফেসর হকিন্স বলেন, এর পরিণতিতে উষ্ণতার কারণে প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপ হতে থাকবে। এর মধ্যে এমন কিছু পরিণতি আছে, যা থেকে পিছন দিকে অর্থাৎ আগের অবস্থায় আর যাওয়া যাবে না। যখন বিষয়টি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আসে, তখন বিজ্ঞানীরা কার্বন নির্গমণের বিভিন্ন লেভেলের মডেল সামনে আনেন। ফলে এই শতাব্দীর শেষের দিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি প্রায় ২ সেন্টিমিটার হওয়ার বিষয় উপেক্ষা করা যায় না। এই ধারা অব্যাহত থাকলে তা ২১৫০ সালে ৫ সেন্টিমিটারে দাঁড়াতে পারে। এমন হলে তাতে উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করা কোটি কোটি মানুষের জীবন হুমকিতে পড়বে। ২১০০ সালের মধ্যে বন্যায় ভেসে যাবে উপকূলীয় অঞ্চল।

বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ ২০১৫ সালের মধ্যে প্যারিস জলবায়ু বিষয়ক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল এই শতাব্দীতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়ামের নিচে ধরে রাখা এবং বিশেষ করে একে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখার জন্য চেষ্টা করা। কিন্তু নতুন রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিজ্ঞানীরা যেসব বৈজ্ঞানিক তথ্য বিবেচনা করেছেন কার্বন নির্গমনের ক্ষেত্রে, তাতে যদি কার্বন নির্গমণ ব্যাপক আকারে কমিয়ে রাখা না যায়, তাহলে এই শতাব্দীতেই উভয় টার্গেট ভেঙে পড়বে। রিপোর্টের লেখকরা মনে করেন, সব কিছুর বিবেচনায় ২০৪০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পৌঁছে যাবে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যদি দুই তিন বছরের মধ্যে কার্বন নির্মাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা না যায়, তাহলে এই ঘটনা আরো আগে ঘটতে পারে। বৃটেনের ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের ড. ফ্রেডেরিক ওটো বলেছেন, আমাদেরকে আরও তীব্র, আরো ঘন ঘন তাপদাহ দেখতে হবে। সারাবিশ্বে আমাদেরকে ভারি বর্ষণের বৃদ্ধি দেখতে হবে। দেখতে হবে আরো ভয়াবহ খরা।

রিপোর্টের ডকুমেন্ট তৈরি করেছে যে ওয়ার্কিং গ্রুপ তার ভাইস চেয়ার প্রফেসর ক্যারোলাইনা ভেরা বলেছেন, এই রিপোর্টে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যে, আমরা এরই মধ্যে প্রতিটি স্থানে জলবায়ুর পরিবর্তনের যে পরিণতি তার মধ্যে বসবাস করছি।


Spread the love

Leave a Reply