যে ছবি কাঁদালো বিশ্ব মানবতা
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ আবারও একটি ছবিকে কেন্দ্র করে কাঁদছে বিশ্ব মানবতা। একটি ছবি। কিন্তু তার মধ্যে সারাবিশ্বে নির্যাতিত, নিপীড়নের শিকার কোটি কোটি মানুষের আর্তনাদ ফুটে উঠেছে। বুঝিয়ে দেয় মানুষ কতটা বিপন্ন হলে জীবনকে তুচ্ছ ভাবে। একটু বাঁচার আশায় সবচেয়ে মূল্যবান জীবনকে বাজি রাখে। আয়লান কুর্দি একবার বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল যুদ্ধের ভয়াবহতা। সমুদ্রের তীরে উপুর হয়ে মৃত পড়ে থাকা ছোট্ট শিশু আয়লান কুর্দি বিশ্বনেতাদের চোখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল সিরিয়ার শরণার্থীদের দুর্দশা।
এবার যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে রিও গ্রান্ডে নদীর তীরে যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো।
এখানে অস্কার আলবার্তো মার্টিনেজ রমিরেজ নামের এক পিতা তার ২৩ মাস বয়সী কন্যা ভ্যালেরিকে পিঠে নিয়ে নদী পাড় হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন ওই নদী পাড়ি দেয়া সম্ভব হবে তার জন্য। কিন্তু এর খরস্রোতের বিষয় তিনি বুঝতে পারেন নি। মেয়েকে পিঠে নিয়ে সাঁতরাতে শুরু করেন রমিরেজ। তিনি পারলেন না। স্রোত তাকে পরাস্ত করলো। রমিরেজ তার কন্যাকে পিঠের সঙ্গে নিয়ে মারা গেলেন। তাদের মৃতদেহ ভেসে উঠলো রিও গ্রান্ডে নদীর তীরে। তখনো ওই ছোট্ট ভ্যালেরি তার পিতার কাঁধ জড়িয়ে ধরে ছিল। তার মাথা পিতার টি-শার্টের ভিতরে। সাংবাদিক জুলিয়া লি ডাক এই ছবি ধারণ করে ছড়িয়ে দেয়ার পর বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে। সিএনএন সহ পশ্চিমা সব টেলিভিশন গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে সেই ছবি আর অভিবাসীদের নির্মমতা। সে ছবি দেখে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘরের কোণে একা একা কাঁদছেন অনেক নরম মনের মানুষ। কঠিন মনের মানুষদের মধ্যেও বড় রকমের খোঁচা দিয়েছে রমিরেজ ও ভ্যালেরির ওই ছবি।
নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, রিও গ্রান্ডে নদীর তীরে কর্দমাক্ত মাটির ভিতরে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে পড়ে আছেন পিতা ও তার কন্যা। কন্যাটির মাথা তার পিতার টি-শার্টের মধ্যে লুকানো। একটি হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পিতার কাঁধের ওপর। রমিরেজ ও তার কন্যা ভ্যালেরি ডুবে মারা যাওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যে সোমবার এই ছবি ধারণ করেছেন সাংবাদিক জুলিয়া। এ ছবিতে ফুটে উঠেছে কি এক অভিপ্রায় নিয়ে তিনি নদী সাঁতরে মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করেছিলেন। মানুষ কি ভয়াবহ যন্ত্রণা আর ঝুঁকি নিয়ে উত্তর দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টা করছে তারই যেন এক জীবন্ত ছবি হয়ে উঠেছে এটি। এমন ঘটনা হয়তো অনেকই ঘটে। কিন্তু তা থেকে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে।
এমন ছবি যুদ্ধ ও অসহনীয় দুর্ভোগের ফলে শরণার্থী অথবা অভিবাসী হওয়া মানুষের ভয়াবহতার বিষয়ে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এতে শক্তিশালী বার্তা প্রকাশ পায়। মনে আছে, সিরিয়ার আলেপ্পোর ধ্বংসাবশেষের নিচ থেকে রক্তাক্ত সিরিয়ান একটি শিশুকে উদ্ধারের কথা। সেই ছবি আইকনিক হয়ে আছে। অথবা একটি অভুক্ত শিশুকে ১৯৯৩ সালে গুলি করে হত্যার কথা। আয়লান কুর্দির কথা। এসব ছবির সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে রমিরেজ ও তার শিশু কন্যার ছবি। মানুষের সচেতনার পর্দা যেন ফুটো করে দিয়েছে এসব।
এল সালভাদরের পরিবার রমিরেজের। তিনি ২৫ বছর বয়সী একজন যুবক। মেয়ে ভ্যালেরি ও স্ত্রী তানিয়া ভ্যানেসা আভালোসকে নিয়ে গত সপ্তাহান্তে তিনি মেক্সিকোর মাতামোরোস শহরের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছেন। তার আশা ছিল, যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করবেন। কিন্তু সোমবার পর্যন্ত সেখানকার আন্তর্জাতিক যে সংযোগ সেতু সেটার কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এ খবর শুনে তারা রিও গ্রান্ডে নদীর তীর ধরে হাঁটা শুরু করেন। এক সময় মনে করেন, এ নদী পাড়ি দিতে পারবেন সাঁতরে।
ফলে পরিবারটি রোববার বিকালে একসঙ্গে যাত্রা শুরু করেন। রমিরেজ তার মেয়েকে পিঠে নেন। তার টি-শার্টের ভিতরে মেয়েকে নিয়ে সাঁতার শুরু করেন। পিছনে সাঁতরাতে থাকেন আভালোস। তিনি ছিলেন পারিবারিক এক বন্ধুর পিঠে। ভ্যালেরিকে পিঠে নিয়ে রমিরেজকে সাঁতরে নদীর অপর পাড়ের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে দেখেন আভালোস। কিন্তু রমিরেজকে আস্তে আস্তে ক্লান্ত হয়ে পড়তে দেখেন তিনি। এ অবস্থায় আভালোস সিদ্ধান্ত নেন, তিনি আর সামনে এগুবেন না। ফিরে আসেন মেক্সিকো প্রান্তে নদীর তীরে।
আভালোস তীরে এসে পিছনে ফিরে তাকান। দেখতে পান তার স্বামী ও কন্যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রান্তে নদীর তীরের খুব কাছাকাছি। এক সময় তারা ডুবে যায়। স্রোত তাদেরকে ভাসিয়ে নিতে থাকে। সোমবার তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করে মেক্সিকো কর্তৃপক্ষ। দেশটির প্রেসিডেন্ট আন্দ্রে ম্যানুয়েল লোপেজ অব্রাডর বলেছেন, যা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।