বিমানের চাকার খোলে লুকিয়ে লন্ডনঃ অতঃপর যা ঘটলো

Spread the love

বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ
বিমানের চাকার খোপের মধ্যে লুকিয়ে ব্রিটেনে অভিবাসী হবার চেষ্টা করতে গিয়ে মারা যাওয়া কেনিয়ান যুবকের ঘটনাটি সারা দুনিয়ায় মানুষের মনে নাড়া দিয়েছে।

এরকম মৃত্যু এই প্রথম নয়।

বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশেরও এক তরুণ চট্টগ্রাম থেকে ওড়া একটি বিমানের চাকার খোপে লুকিয়ে সৌদি আরব যাবার চেষ্টা করেছিল বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল। বিমানটি সৌদি আরব অবতরণ করার পর তার মৃতদেহ পাওয়া যায়।

কিন্তু এভাবে যারা আরেক দেশে যেতে চায় তারা ঠিক কোথায় এবং কিভাবে লুকিয়ে থাকে? বিমানটি যখন আকাশে উড়ছে তখন সেখানকার পরিবেশ কেমন হয়?

আর, কেউ এরকম করলে তার মৃত্যু কি অনিবার্য? নাকি কেউ কেউ ভাগ্যক্রমে বেঁচেও যেতে পারে?

রোববার বিকেলে লন্ডনে অবতরণের আগে – নাইরোবি থেকে আসা কেনিয়ান এয়ারওয়েজের বিমানটির ল্যান্ডিং গিয়ারের ঢাকনা খোলার পর – লুকিয়ে থাকা লোকটির মৃতদেহ পড়ে যায় ক্ল্যাপহ্যাম এলাকার এক বাড়ির বাগানে।

বিস্ময়করভাবে, এত উঁচু থেকে পড়লেও তার মৃতদেহটি প্রায় অক্ষত ছিল। কিন্তু ভালো করে দেখার পর পরিষ্কার হয়: কেন তা ঘটেছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন: লোকটির দেহটা জমে গিয়ে একটা বরফের টুকরোর মত হয়ে গিয়েছিল।

ইউরোপে স্থলপথে বা সমুদ্র পার হয়ে অভিবাসী হবার চেষ্টা প্রতিনিয়তই ঘটছে, কিন্তু বিমানে লুকিয়ে ইউরোপে আসার চেষ্টা বেশ বিরল।

এর কারণ অনুমান করা কষ্টসাধ্য নয়।

বিমানের নিচের দিকে চাকার খোলের ভেতরে বিবিসির সাংবাদিক রব ওয়াকার
বিমানের নিচের দিকে চাকার খোলের ভেতরে বিবিসির সাংবাদিক রব ওয়াকার

এভিয়েশন সাংবাদিক ডেভিড লিয়ারমন্ট বলছেন, কারণ উড়ন্ত বিমানের চাকার খোপের ভেতরে আপনার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।

কেমন পরিবেশ হয় ল্যান্ডিং গিয়ারের ভেতরে?
মি. লিয়ারমন্ট বলছেন, “প্রথম চ্যালেঞ্জটা হলো, প্লেনটা আকাশে ওড়ার পর পরই যখন চাকাগুলো গুটিয়ে আবার খোপের ভেতরে ঢুকে যায় – সেই সময়টা। ”

“এ সময় ওই ভাঁজ হতে থাকা চাকাগুলো আপনাকে পিষে মেরে ফেলতে পারে।”

উড়ন্ত বিমান থেকে মৃতদেহ পড়লো বাড়ির বাগানে

দ্বিতীয় ঝুঁকি: গরম আবহাওয়ায় বিমানের ব্রেকগুলো অসম্ভব উত্তপ্ত হয়ে যায়, এবং এর কাছে থাকা অবস্থায় আপনি গরমে ভাজাভাজা হয়ে মারা যেতে পারেন।

তবে ধরে নেয়া গেল, আপনি ভাগ্যবান এবং এই প্রথম দুটো ঝুঁকি আপনি পার হয়ে এসেছেন।

কিন্তু বিমানটি যখন আকাশে উড়ছে, তখন আপনার সামনে আরো দুটো ভয়ংকর বিপদ উপস্থিত। একটি হলো ঠান্ডায় জমে যাওয়া। দ্বিতীয়টি হলো অক্সিজেনের তীব্র অভাব।

মনে রাখতে হবে বিমানের ভেতরে যেখানে যাত্রীরা বসেন – সেখানে বাতাসের চাপ, অক্সিজেনের পরিমাণ এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এত উচ্চতায়ও মানুষের বেঁচে থাকার উপযোগী পরিবেশ কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয় ।

কিন্তু বিমানের চাকার খোপে তা করা হয় না।

দূরপাল্লার যাত্রায় বিমান ওড়ে অন্তত ৩৫,০০০ ফিট উচ্চতায়। সেখানে বিমানের বাইরের তাপমাত্রা শূন্যের নিচে ৫০ থেকে ৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে। সেটা হচ্ছে এ্যান্টার্কটিকায় শীতলতম অংশে বছরের গড় তাপমাত্রার সমান।

এই ঠান্ডায় সাধারণ কাপড়চোপড় পরে মানুষের পক্ষে বেশিক্ষণ বেঁচে থাকা কঠিন।

তা ছাড়া বিমান যখন মাটি থেকে প্রায় ৬-৭ মাইল ওপর দিয়ে উড়ছে – সেখানে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ খুবই কম এবং বাতাসের চাপও খুব কম।

তাই সে অবস্থায় শ্বাস নেবার সময় মানুষের ফুসফুস ঠিকমত ফোলে না এবং যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন নিতে পারে না।

এটাও কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাবার মতোই এক পরিস্থিতি।
তাই বিমানের চাকার খোলে লুকিয়ে যারা বিদেশ যাবার চেষ্টা করেন তাদের বেশির ভাগই বিমান অবতরণের অনেক আগেই ঠান্ডায় এবং অক্সিজেনের অভাবে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন – অথবা মারা যান।

বিমান অবতরণের সময়ও বিপদ
বিমানটি যখন মাটিতে নামার জন্য এয়ারপোর্টের কাছাকাছি আসছে, তখন ল্যান্ডিং গিয়ারের খোপের ঢাকনাটি খুলে যায়।

সেসময় কেউ এর ভেতরে থাকলে তাকে পড়ে যাওয়া ঠেকাতে খুবই সতর্ক থাকতে হবে, নিরাপদ জায়গায় স্থির থাকার জন্য তার গায়ে যথেষ্ট শক্তি থাকতে হবে।

মি. লিয়ারমাউন্ট বলছেন, লুকিয়ে থাকা লোকদের বেশিরভাগই এ সময়টায় বিমান থেকে পড়ে যান – কারণ তারা একটা বিপজ্জনক জায়গায় বসা, অথবা তারা ইতিমধ্যেই অজ্ঞান হয়ে গেছেন, বা মারা গেছেন।

সবাই কি মারা যায় ? নাকি কেউ কেউ বেঁচে থাকতে পারেন?
বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ এ্যালেস্টেয়ার রোজেনশাইন বলছেন, “বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম, প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।”

মার্কিন ফেডারেল বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (এফএএ) ১৯৪৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত এধরণের ঘটনাগুলোর উপাত্ত পরীক্ষা করেছে।
বিমানের চাকার খোলে লুকিয়ে ভ্রমণের চেষ্টাকারীদের ইংরেজিতে বলা হয় ‘স্টোএ্যাওয়ে’।

এফএএ বলছে, গত ৭২ বছরের সময়কালে ১১২টি ফ্লাইটে ১২৬টি স্টোএ্যাওয়ের ঘটনা ঘটেছে।

বিমান থেকে পড়া লোকেরা বেশির ভাগই ছিল হিথরোগামী ফ্লাইটে
বিমান থেকে পড়া লোকেরা বেশির ভাগই ছিল হিথরোগামী ফ্লাইটে

এই ১২৬ জনের মধ্যে ৯৮ জন বিমান অবতরণের আগেই মারা গেছেন, বেঁচে গেছেণ ২৮ জন – এবং বিমান অবতরণের পর তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

যারা নিহত হয়েছেন – তাদের অনেকে বিমান উড্ডয়ন বা অবতরণের সময় নিচে পড়ে গেছেন অথবা চাকার খোলের মধ্যেই মারা গেছেন।

এফএএ-র উপাত্ত অনুযায়ী ৪০টি দেশে এমন ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি ঘটেছে কিউবা (৯টি) চীন (৭টি) ডমিনিকান রিপাবলিক (৮টি) দক্ষিণ আফ্রিকা (৬টি) এবং নাইজেরিয়া (৬টি)। কোন কোন ক্ষেত্রে বিমান যেখান থেকে উড়েছে সে তথ্য পাওয়া যায়নি।

আঞ্চলিকভাবে দেখতে গেলে – বিমানের নিচে লুকিয়ে বিদেশে যাবার চেষ্টা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে আফ্রিকায় (৩৪টি), ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে (১৯টি), এবং এশিয়ায় (১২টি)

বিমান থেকে পড়লো লাশ
লন্ডনের হিথরো বিমান বন্দরে অবতরণের পথে আকাশ থেকে লাশ পড়ার ঘটনা এর আগে বেশ অনেকবার ঘটেছে।

২০১৫ সালে পশ্চিম লন্ডনে একটি অফিস ভবনের ছাদে একজন লোকের মৃতদেহ পাওয়া যায়। পরে জানা যায়, জোহানেসবার্গ থেকে হিথরোগামী ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি বিমান থেকে এই মৃতদেহটি পড়েছে।

তার একজন সঙ্গীকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তারা পড়েছিল ৪২৭ মিটার ওপর থেকে।

এর তিন বছর আগে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লন্ডনের রাস্তায় জোসে মারাদা নামে মোজাম্বিকের এক নাগরিকের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরে জানা যায় এ্যাঙ্গোলা থেকে আসা একটি বিমান থেকে সে পড়ে গিয়েছিল।

ওই একই বছর কেপটাউন থেকে আসা একটি বিমান হিথরোয় অবতরণ করার পর তার নিচে মালপত্র রাখার কুঠরিতে একজন লোকের মৃতদেহ পাওয়া যায়।

চাকার খোলে লুকিয়ে বিমানযাত্রার পর কতজন বেঁচেছেন?

বিশেষজ্ঞদের মতে এরকম ক্ষেত্রে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত, কিন্তু কিছু লোক সত্যি এর পরও বিস্ময়করভাবে বেঁচে গেছেন।

তবে এই দু:সাহসের মূল্য তাদের দিতে হয়েছে নানাভাবে।

বেঁচে-যাওয়াদের বেশির ভাগই হাত-পা হারিয়েছেন। কারণ চরম ঠান্ডায় তাদের হাত-পায়ে ফ্রস্টবাইট হয়ে গিয়েছিল অর্থাৎ মাংসপেশী সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

ফলে তাদের হাত বা পা কেটে বাদ দিতে হয়।

তবে হ্যাঁ, কম দূরত্বের ফ্লাইট যেখানে বিমান অপেক্ষাকৃত নিচু দিয়ে ওড়ে সেখানে স্টোএ্যাওয়ে-দের বেঁচে যাবার কিছুটা সম্ভাবনা থাকে – এটা বলা যায়।

২০১০ সালে ভিয়েনা থেকে একটি প্রাইভেট বিমানের নিচের কুঠরিতে লুকিয়ে লন্ডনের হিথরোতে এসে নেমেছিলেন ২০ বছরের এক রোমানিয়ান তরুণ।

তা ছাড়া ২০১৫ সালে জোহানেসবার্গ থেকে আসা একটি বিমানে লুকিয়ে থাকার যে দুই যুবকের কথা আগে বলা হয়েছে – তার একজন মারা গেলেও অপরজন বেঁচে গেছেন।

এরকম ঘটনা আরো আছে।

কিউবা থেকে পালিয়ে ১৯৬৯ সালে মাদ্রিদে এসে নেমেছিলেন আরমান্দো সোকারাস রামিরেজ (২২)। তার ফ্রস্টবাইট হলেও শরীরের তেমন কোন ক্ষতি হয় নি।

১৯৯৬ সালে দিল্লি থেকে বিমানের খোলে লুকিয়ে লন্ডন আসতে চেয়েছিলেন – দুই ভাই বিজয় আর প্রদীপ সাইনি। হিথরোতে নামার পথে খোল থেকে নিচে পড়ে মারা যান বিজয়, কিন্তু প্রদীপ বেঁচে যান।

২০০০ সালে তাহিতি থেকে লসএঞ্জেলেসগামী বিমানে লুকিয়ে ৪,০০০ মাইল পথ পাড়ি দিযেও বেঁচে থাকেন ফিদেল মারুহি।

২০০২ সালে কিউবা থেকে কানাডার মন্ট্রিয়লগামী বিমানে চার ঘন্টার ফ্লাইটের শেষ পর্যন্ত টিকে ছিলেন ভিক্টর আলভারেজ মোলিনা।

২০১৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সান জোসে থেকে হাওয়াইয়ের মাওয়ি পর্যন্ত লুকিয়ে বিমানভ্রমণ করেন ইয়াহিয়া আবদি।

এভাবে বিদেশে যাবার ঝুঁকি কারা নেবেন?
বিমান থেকে মানুষের লাশ পড়ার শেষ ঘটনাটি ঘটেছে লন্ডনে ক্ল্যাপহ্যাম এলাকার এক বাড়ির বাগানে – যা হিথরোগামী বিমানের ওড়ার পথেই পড়ে।

সাংবাদিক লিয়ারমাউন্ট বলছিলেন, প্রতিটি বিমানেরই নিচের দিকটা ওড়ার আগে পরীক্ষা করা হয়।

এ কাজটা করে একজন স্থানীয় গ্রাউন্ড মেকানিক বা ক্রু এবং কখনো কখনো তারা দুজনে মিলেই এ পরিদর্শনের কাজটা করে।

ফলে কেউ যদি বিমানের চাকা বা মালপত্রের কুঠরিতে ঢুকতে চায়, তা করা হয় একেবারে শেষ মুহুর্তে।

তাই যারা এ কাজটা করতে সক্ষম হয় – তারা প্রায়ই হয়ে থাকে অদক্ষ কোন বিমানবন্দর কর্মচারী, বা অন্য কোন কর্মীর পরিচিত জন – যাদের এই এলাকায় থাকার মতো নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্স আছে।

কিন্তু লিয়ারমাউন্ট মনে করেন – যারা এভাবে প্লেনে উঠতে চায় – তারা হয়তো জানে না যে এই চেষ্টাটা কত বিপজ্জনক ।

এতে রয়েছে প্রায় নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি।


Spread the love

Leave a Reply