যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের মিত্রতা নিয়ে প্রশ্ন
বাংলা সংলাপ ডেস্ক: মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় (৩১ জানুয়ারি) আঞ্চলিক জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে আসছে যুক্তরাজ্য। এই বিচ্ছেদ আটলান্টিকের ওপারের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় করবে-এমনটাই জাহির করে আসছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জনসন। কিন্তু ট্রাম্প সরকারের একের পর এক কার্যকলাপে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের মিত্রতা নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
বছরের শুরুতে ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানের শীর্ষ ক্ষমতাধর সামরিক কমান্ডার কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। এ ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত পশ্চিমা সৈনিক, নাগরিক ও স্বার্থগুলো ইরানের প্রতিশোধের নিশানায় তৈরি হয়। ইরাকে ৪শ ব্রিটিশ সৈন্য নিয়োজিত রয়েছে। আছে দূতাবাস এবং ব্রিটিশ বিনিয়োগ।
কিন্তু ইরানের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার পরিকল্পনা এবং এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে মিত্রদেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আগাম কোনো আলোচনাই করেনি যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়েন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তাঁকে দ্রুত ক্যারিবিয়ান দ্বীপ মাস্টিকে অবকাশ যাপন ফেলে দেশে ফিরতে হয়।
ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলীয় এমপি টম টুজেনডাথ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্রতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘আমার ধারণা ছিল মিত্রতা থাকার অর্থ্য হচ্ছে আমরা শত্রুদের অবাক করব-একে অপরকে নয়।’ সংসদের গত মেয়াদে পররাষ্ট্র-বিষয়ক কমিটির চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা টুজেনডাথ অভিযোগ করেন- যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবেই এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের বিষয়ে আগাম তথ্য প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে।
সোলাইমানিকে হত্যার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব ব্যাপার মন্তব্য করে মিত্রতার প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন বরিস। কিন্তু ওই ঘটনায় ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের আস্থাহীনতা যে বেড়েছে তা স্পষ্ট। ব্রিটিশ সরকার সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর সঙ্গে মিলে এক যৌথ বিবৃতিতে উভয় পক্ষকে সংঘাত এড়ানোর আহ্বান জানায়।
যুক্তরাজ্য সরকারের মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের আচরণ নিয়ে অসন্তোষ আরও স্পষ্ট হয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেসের বক্তব্যে। ১২ জানুয়ারি সানডে টাইমসে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র যে আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব থেকে সরে আসছে-বিষয়টি আমাকে রাতে জাগিয়ে রাখে। এ পরিস্থিতি যুক্তরাজ্যকে নিজস্ব প্রতিরক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে।’
গত ২২ জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনে ঘটে আরেক কাণ্ড। সেখানে প্যানেল আলোচনায় যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী (চ্যান্সেলর) সাজিদ জাভিদ এক প্রশ্নের জবাবে জানান যে, যুক্তরাজ্য আসছে এপ্রিল থেকে ‘ডিজিটাল ট্যাক্স’ চালু করতে যাচ্ছে। এর ফলে মার্কিন কোম্পানি অ্যাপল, আমাজন এবং ফেসবুকের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্তরাজ্যে অর্জিত আয়ের ওপর ২ শতাংশ হারে কর প্রদান করতে হবে।
প্রতিক্রিয়ায় প্যানেলে উপস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী (ট্রেজারি সেক্রেটারি) স্টিভ মাছিন বলেন, মার্কিন কোম্পানিগুলোর ওপর করারোপ করা হলে যুক্তরাষ্ট্রও ইউরোপের গাড়ির ওপর পাল্টা করারোপ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের এমন হুমকিতে ইতিমধ্যে ফ্রান্স ডিজিটাল ট্যাক্স কার্যকর করার পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে। এখন ব্রিটিশরা কি করবে সেটি নিয়েই চলছে নানা আলোচনা।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক প্রশ্নের মুখে পড়েছে আরও একটি ঘটনায়। গত বছরের আগস্টে নর্থাম্পটনশায়ারে গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হন হ্যারি ডান নামের এক সাইকেলারোহী তরুণ। সন্দেহভাজন গাড়িচালক মার্কিন নাগরিক অ্যান চাকোলাস কূটনৈতিক দায়মুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত যুক্তরাজ্য থেকে কেটে পড়েন। অ্যানের স্বামী একজন মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যিনি ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছিলেন।
হ্যারি ডান নিহত হওয়ার ঘটনার বিচার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন তরফ থেকে ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ বাড়ে। বাধ্য হয়ে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অ্যান চাকোলাসকে প্রত্যর্পণের (এক্সট্রাডিশন) জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ পাঠায়।
কিন্তু গতকাল শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এক চিঠিতে সেই অনুরোধ সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোমিনিক রাব বলেন, ‘এটা বিচারের অধিকার অস্বীকার করার শামিল’। এ ঘটনায় চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে বরিসের সরকার। কেননা, মার্কিন সরকারের অনুরোধে যুক্তরাজ্য থেকে অনেককে প্রত্যর্পণের নজির আছে।
সম্প্রতি এসব ঘটনার পাশাপাশি ইঙ্গ-মার্কিন মিত্রতায় বহুদিন যাবৎ গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে চীনের কোম্পানি হুয়াওয়েকে যুক্তরাজ্যে ‘ফাইভ জি’ নেটওয়ার্ক স্থাপনে যুক্ত করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোর আপত্তি। হুয়াওয়ে চীন সরকারের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করে বলে অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের। তাই হুয়াওয়েকে ফাইভ জি স্থাপনের কাজ দেওয়া হলে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে গোপন তথ্য আদান-প্রদান বন্ধ করে দেবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে দেশটি। কিন্তু খরচ কমিয়ে রাখতে এবং সেরা প্রযুক্তির জন্য হুয়াওয়েকেই পছন্দ ব্রিটিশদের।
শনিবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতির বরাত দিয়ে গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়, হুয়াওয়েকে কাজ দেওয়া নিয়ে গত শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ফাইভ জি স্থাপনের কাজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ঘনিয়ে আসায় বিষয়টি নিয়ে একটি সমাধানে পৌঁছাতে ব্যস্ত ব্রিটিশ সরকার।
বিতর্কিত আচরণের জন্য সমালোচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বরিস জনসনের বন্ধুত্বের বিষয়টি সবার জানা। যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে ট্রাম্প প্রকাশ্যেই বরিসকে সমর্থন দিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের মানুষ বরিসকে যে ‘ব্রিটিশ ট্রাম্প’ বলে ভর্ৎসনা করে, তা নিয়েও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তিনি সুযোগ পেলেই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যকার ‘বিশেষ সম্পর্ক’র কথা বড়াই করে বলেন।
অথচ ট্রাম্প সরকারের কার্যকলাপে ‘বিশেষ সম্পর্ক’র কোনো আলামত মিলছে না। খোদ ব্রিটিশ রাজনীতিকেরাই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মিত্রতা নিয়ে এখন প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। ইইউ থেকে বিচ্ছেদের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার মাধ্যমে আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে আনার যে স্বপ্ন দেখছিল যুক্তরাজ্য, এখন সেই স্বপ্নও অনেকটা ফিকে হয়ে আসছে।