নিত্যদিনের বৈষম্য যেভাবে ফ্রান্সের সহিংসতায় ইন্ধন জুগিয়েছে
প্যারিসের এক শহরতলীতে পুলিশের গুলিতে আলজেরীয় বংশোদ্ভূত নাহেল এম নামের ১৭-বছরের এক মুসলিম তরুণের মৃত্যু নিয়ে যে ভয়াবহ দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল তা ফরাসী সমাজের মূলে নাড়া দিয়েছে। যে মাত্রায় ঐ দাঙ্গা হয়েছে এবং যে দ্রুততার সাথে তা ফ্রান্স জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল তা নজিরবিহীন।
যে শহরে গত এক বছর ধরে বসবাস করছি সেই মার্সেইতে দাঙ্গার দিনগুলোতে হঠাৎ যেন জনজীবন আমূল পাল্টে গিয়েছিল। শহরের বাসিন্দারা ধরেই নিত সন্ধ্যা নামলেই সহিংসতা শুরু হবে। দোকান-পাট তার আগেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, জনপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হচ্ছিল। ফলে মানুষজন বিকেলের মধ্যে কাজ, কেনাকাটা করে ঘরে গিয়ে ঢুকছিল।
আর সন্ধ্যার পর সত্যিই শুরু হতো পুলিশ আর দাঙ্গাকারীদের মধ্যে ইঁদুর-বেড়াল খেলা।, পুলিশের গাড়ির সাইরেন আর আকাশে পুলিশের হেলিকপ্টারের শব্দ এবং সেইসাথে ক্রমাগত বাজির বিস্ফোরণ।
সকাল বেলা টিভি রেডিওতে চলতো একের পর এক টক-শো। যারা সেখানে কথা বলতেন তাদের সবার মুখেই ছিল প্রায় একইরকম ব্যাখ্যা। মনে হতো যেন একটি পক্ষ নিয়ে কথা বলতেই তাদের অনুষ্ঠানে ডাকা হয়েছে।
পুলিশ ইউনিয়নের মুখপাত্র, আইন বা রাজনীতির বিশেষজ্ঞ বা রাজনৈতিক নেতা যারই মিডিয়ার এসব অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে এই দাঙ্গা কারা করছে এবং এই দাঙ্গা কেন হচ্ছে বলে যেসব ব্যাখ্যা তুলে ধরতেন তা যেন প্রায় একই সূরে বাধা ছিল।
চতুর্থ প্রজন্মের অভিবাসীরাও কেন ফরাসী সমাজের অংশ হতে পারে না?
যদিও তারা সবাই নাহেলের ওপর গুলির সমালোচনা করছিলেন, কিন্তু ঘুরেফিরে তাদের অনেকেই সেই পুরনো ইস্যু তুলতে শুরু করেন আর তা হলো – ফ্রান্সে অভিবাসন।
এসব টক-শোতে একটি প্রশ্ন ছিল অবধারিত: “কেন তৃতীয় এবং চতুর্থ প্রজন্মের অভিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে এদেশের নাগরিক হয়েও ফরাসী সমাজের অংশ হতে পারছেনা?”
আরেকটি যে প্রশ্ন আমার সবচেয়ে বেশি নজর কাড়তো : “এসব দাঙ্গাকারীরা কী বুঝতে পারছে না তারা তাদের নিজেদের সম্পত্তিই ধ্বংস করছে?”
দশকের পর দশক ধরে ফ্রান্সে এসব প্রশ্নই ফ্রান্সে বার বার উঠছে। ফলে শুনতে শুনতে আমার মনে হতো কেন এতদিনেও এসব প্রশ্নের জবাব মিলছে না প্রশ্নকর্তারা কি তা বুঝতে পারেননা? তারা কি সত্যিই এই প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন?
যুক্তরাষ্ট্রের কেনিয়ন কলেজে ২০০৫ সালে প্রখ্যাত আমেরিকান ঔপন্যাসিক ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসের একটি ভাষণ প্রায়ই আমার মনে পড়ে। তার ভাষণে ঐ লেখক রূপক একটি গল্পের অবতারণা করেছিলেন। গল্পটি এমন : দুটো কম বয়সী মাছ সাঁতরে একটি বয়সী মাছকে অতিক্রম করে যাওয়ার সময় মাছটি তাদের প্রশ্ন করে “পানি কেমন লাগছে আজ?”কিছুক্ষণ পর ঐ দুই মাছের একজন তার সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করে: “পানি কী বস্তু?”
এই গল্পটি বলে ওয়ালেস বলেন, “মাছের এই গল্পের অর্থ হলো অবধারিত সত্য বিষয়গুলো মানুষ দেখতে পারেনা বা দেখতে চায়না অথবা তা নিয়ে কথা বলতে চায়না।
‘অনেক ফরাসী মুসলিম অভিবাসনকে সমস্যা হিসাবে দেখে’
পুলিশের গুলিতে নাহেলের মৃত্যুর আগের কয়েক সপ্তাহে প্রথম সারির কিছু মিডিয়ায় এবং বেশ কজন রাজনীতিকের মুখ থেকে ফ্রান্সের মুসলিম এবং আলজেরীয় অভিবাসীদের সম্পর্কে খুবই উস্কানিমূলক বক্তব্য বিবৃতি শোনা গেছে।
জুনের প্রথম দিকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডুওয়ার্ড ফেলিপে মিডিয়ায় তার এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে অভিবাসন আইনে ব্যাপক সংস্কারের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, অনেক ফরাসী বিশ্বাস করে যে এমনকি দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্মের অনেক অভিবাসী সত্যিকারের নাগরিক হতে পারেনি। তারা মনে করে এসব অভিবাসী শিক্ষা বিমুখ, সমাজে তাদের কোনো অংশগ্রহণ নেই এবং ফ্রান্সের নাগরিক রীতিনীতির তারা ধার ধারেনা। মি. ফেলিপে স্পষ্ট গলায় বলেন, অনেক ফরাসী মুসলিম অভিবাসনকে সমস্যা হিসাবে দেখে। তিনি বলেন মানুষের এসব উদ্বেগকে অবজ্ঞা করা উচিৎ নয়।
“এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, অস্বস্তিকর বিষয়, ভীতিকর বিষয়,” বলেন মি. ফেলিপে।
ঐ সাক্ষাৎকারে তিনি আলজেরিয়ার সাথে ফ্রান্সের একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বাতিলের সুপারিশ করেন যে চুক্তির ফলে সেদেশ থেকে ফ্রান্সে অভিবাসন অপেক্ষাকৃত সহজ।
এরপর জুন মাসেই, ফ্রান্সের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল , বিএফএম টিভি, লিওঁ শহরের একটি স্কুলের গেটের মুখের ভিডিও ফুটেজ তুলে দেখায় যে কতজন ছাত্রী আবায়া (গলা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা পোশাক যা আরব দেশগুলোর রক্ষণশীল সমাজের মেয়েরা পরে) গায়ে স্কুলে ঢুকছে।
এই রিপোর্ট প্রকাশের মূল উদ্দেশ্যই ছিল মানুষকে দেখানো যে লাইসিতে অর্থাৎ জনসমক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতার যে রীতি ফ্রান্সে প্রচলিত তা ভেঙ্গে কীভাবে স্কুলে ধর্মীয় আচরণের প্রদর্শন ঢুকে পড়ছে।
ফুটেজে দেখা যায়, অনেক মুসলিম ছাত্রী স্কুলের গেট পর্যন্ত গিয়ে সেখানে মাথার হিজাব খুলে ভেতরে ঢুকছে। দেখে মনে হয় যেন ফরাসী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জোর করে মুসলিম ছাত্রীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের পোশাক খুলে নিচ্ছে
স্কুলে আবায়া পরে যাওয়া নিয়ে টিভিতে এই বিতর্ক সৃষ্টির আগে নিস শহর থেকে একটি খবর আসেন যে সেখানকার একটি স্কুলে নয় থেকে ১১ বছরের কিছু মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী স্কুলের চত্বরে নামাজ পড়েছে।
ঐ ঘটনার পর নিসের মেয়র ক্রিস্টিন এসট্রোসি, যিনি ফ্রান্সের দক্ষিণ-পন্থী একটি রাজনৈতিক দলের নেতা, এবং সেইসাথে ফ্রান্সের শিক্ষামন্ত্রী পাপ এনদিয়ায়ে ঐ শিশুদের প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন।
তার কিছুদিন পর এবং আসন্ন নারী বিশ্বকাপ ফুটবলের ক-সপ্তাহ আগে ফ্রান্সের একটি আদালত মুসলিম নারী ফুটবলারদের হিজাব পরার ওপর চাপানো নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখে।
যে পুলিশ কর্মকর্তার গুলিতে নাহেল মারা গেছে, সে এখন আটক। কিন্তু কিছু দক্ষিণ-পন্থী তাকে আইন সহায়তা দিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্যাম্পেইন শুরু করে মাত্র ক’দিনেই মানুষের কাছ থেকে ১৬ লাখ ইউরো চাঁদা তুলেছে। সেই প্রচারণা অবশ্য সরকার এখন বন্ধ করে দিয়েছে।
বামপন্থী রাজনীতিকরা এই ক্যাম্পেইনের সমালোচনা করেছেন, কিন্তু দক্ষিণ-পন্থী অনেক রাজনীতিক একে সমর্থন করে বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন যে তারা পুলিশের পক্ষে।
এসব ঘটনা ফ্রান্সের অনেক মুসলিম, এবং বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসী মুসলিমদের মনে বদ্ধমূল ধারনা তৈরি করেছে যে ফরাসী রাষ্ট্র এবং সমাজে তাদের স্থান নেই, এবং বুঝতে অসুবিধা হয়না যে কেন তারা নাহলের মৃত্যুতে এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছিলেন, “দাঙ্গা হচ্ছে উপেক্ষিত মানুষের ভাষা”। গত সপ্তাহে, এবং সম্ভবত তাদের জীবনে প্রথম, ক্রদ্ধ-হতাশ এসব ফরাসী মুসলিম তরুণ-যুবক তাদের মনোভাব প্রকাশ করেছে।