এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি!

Spread the love

ফজলুল কবির:

সুর কিংবা কথা, যে কারণেই হোক দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধন-ধান্যে পুষ্পে ভরা’ গানটি খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে যখন বলে ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ তখন, নিজের অজ্ঞাতেই বুকের ছাতিটা যেন একটু বড় হয়ে যায়। নিজের জন্মভূমি, বাসভূমি পৃথিবীর সেরা—এ কল্পনাও হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে গৌরবের উত্তাপে। কিন্তু এখন এই একই লাইন মনে পড়ছে আর কুঞ্চিত হয়ে যেতে হচ্ছে ভেতরে-ভেতরে। সত্যি তো হত্যা, মৃত্যু, লাঞ্ছনার মাঝেও নির্জীব নিস্পৃহ জনতার এমন দেশ কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে?

এই দেশ ও দেশের রুটিনমাফিক মানুষেরা এখন দীর্ঘ যন্ত্রণাময় লড়াই শেষে জীবনকে বিদায় জানানো সোনাগাজীর নির্যাতিত মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে নিয়ে হা-হুতাশ করছেন। এটা চলবে হয়তো আরও কিছুদিন। যথাযথ প্রতিস্থাপনের আগ পর্যন্ত, পরের নুসরাতের দেখা মেলার আগ পর্যন্ত। নতুন আরেকটি ঘটনা সবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেবে। রিমোটের মালিকানা বুঝে নেওয়া মানুষেরা নির্দ্বিধায় চ্যানেল বদলে নেবে। সামনে তো অপেক্ষায় রয়েছেই মনোহর বিশ্বকাপ। ছোটার এই সময়ে ঘটনার অভাব কে আর বোধ করেছে কবে?

নুসরাত মারা গেছেন, জীবনের দিকে তীব্র প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েই। কলের পুতুলের মতো প্রতিবাদ করা, প্রতিবাদ না করা, যেকোনো ঘটনায় তরমুজের ফালির মতো বিভাজিত হয়ে যাওয়া, সত্যজিতের ‘যন্তর-মন্তর’ থেকে বের হওয়া মানুষের দিকে তাক করা তির্যক চাহনিটি অবশেষে বুজেছে সে। এই তির্যক চাহনি হয়তো কিছুকাল কিছু মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াবে, হয়তো কিছু রাত ঘুমের ভেতরে কেউ কেউ তীব্র আগুন দেখে চিৎকার দিয়ে জেগে উঠবে; কিন্তু ওই পর্যন্তই। ওই পর্যন্তই যে, তার প্রমাণ হচ্ছে যেদিন নুসরাত চোখ বুজলেন, সেই একই দিন রেললাইনের পাশে গলায় গামছার ফাঁস প্যাঁচানো আরেক মাদ্রাসাছাত্রের লাশ পাওয়া গেল। ১০ বছরের শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু কেউ কিছু বলেননি। খবরটি নাগরিকেরা দারুণ দক্ষতায় গিলে ফেলেছেন।সোনাগাজীর সেই মাদ্রাসাশিক্ষার্থী।

নুসরাতকে অপমান করেছিলেন স্থানীয় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, আরও ভয়াবহ অপমানজনক প্রস্তাব দিয়ে। নুসরাতের মা মামলা করেছিলেন। প্রতিকার চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের কাছে। নুসরাত তাঁর সহপাঠীদের প্রশ্ন করেছিলেন, তাঁরা কি জানেন না অধ্যক্ষ কেমন? তাহলে তাঁর পাশে তাঁরা থাকছেন কীভাবে? তাঁরা প্রতিবাদ করছেন না কেন? পাবলিক পরীক্ষার হলও তাঁর জন্য নিরাপদ থাকল না। আগুনে পুড়ে যেতে হলো তাঁকে। এই নুসরাত যখন হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, আর মানুষেরা সময়ের শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনাটির পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে সব চ্যানেল একদিকে ঘুরিয়ে বসে আছে, তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার এক গ্রামে সারা রাত আটকে রেখে এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর তাকে তার বাড়ির পাশেই ফেলে রাখা হয়। ষষ্ঠ শ্রেণির ওই শিক্ষার্থীকে স্কুল থেকে ফেরার সময় তুলে নেওয়া হয়েছিল।সুবিচার চাইলেন বাবা এ কে এম মুসা। ছবি: আসাদুজ্জামান।

সুবিচার চাইলেন বাবা এ কে এম মুসা। ছবি: আসাদুজ্জামান।নুসরাত যখন অন্তিম লড়াইটা করছেন, তখন আরেক ষাটোর্ধ্ব বাবা তাঁর প্রয়াত মেয়ের ছবিসংবলিত একটি ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সামনে। সেখানে লেখা, ‘আমার একমাত্র কন্যা কামরুন নাহার তুর্ণা হত্যার বিচার চাই এবং আমার জীবনের নিরাপত্তা চাই ।’ তাঁর নাম মফিজুল হক। তুর্ণার লাশ দুই বছর আগে তাঁর শ্বশুরবাড়ির পরিত্যক্ত পানির ট্যাংক থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় মৃত পড়ে থাকা তুর্ণা ছিলেন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। দুই বছরে তুর্ণা হত্যার বিচার না হলেও মফিজুল হকের জীবনের নিরাপত্তা শঙ্কায় পড়েছে। মফিজুল হক দুই-ই চাইতে হাজির হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সামনে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সামনে একমাত্র মেয়ে কামরুন নাহার তুর্নার হত্যার বিচার ও নিজের জীবনের নিরাপত্তার দাবিতে ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়ান বাবা মফিজুল হক। ১০ এপ্রিল,ব্রাহ্মণবাড়িয়া । ছবি: প্রথম আলোনুসরাত যেদিন চলে যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন, সেই ১০ এপ্রিল খবর এল, ৮ বছর বয়সী আরেক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর অপহরণ ও মৃত্যুর কারণ তারই শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ। নুসরাতের লড়াইটা যেন কত দীর্ঘ সময় ধরে চলল। আর এর মধ্যেই চিকিৎসা চাইতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ধর্ষণের শিকার হলেন এক গৃহবধূ। কবিরাজ লাল চান বাবু এখন পুলিশ হেফাজতে। ঠিক একই সময়ে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় এই নারায়ণগঞ্জেই বাড়ি ভেঙে দেওয়া হলো এক দম্পতির। একই দিনে মাদারীপুরে গোসল করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হলো প্রথম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। আর ফরিদপুরে আড়াই বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠল।

এই ঘটনাগুলো একটি দুঃসময় চিত্রিত করতে উল্লেখ করা হয়নি। না, এর মধ্যে কোনো অভিসন্ধি নেই। কোনো অসময়ের চিত্রনাট্য লেখার জন্যও এসবের অবতারণা করা হয়নি। ঘটনাগুলোর পুনরুল্লেখ করা হয়েছে শুধু নিজের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকানোর জন্য। রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে থাকা নিরাপত্তার সুনির্দিষ্ট সম্বন্ধটি বোঝার জন্য। নাগরিকেরা রাষ্ট্রকে নির্মাণ করে কিছু সুনির্দিষ্ট শর্তে। তার মধ্যে সবচেয়ে মুখ্য শর্তটি হচ্ছে নিরাপত্তা। অথচ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা নুসরাতের শেষ দুদিনের জীবদ্দশার মধ্যে ওপরে উল্লিখিত (ঈষৎ সংক্ষেপিত) ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে, যেখানে ভুক্তভোগী হয় শিশু, নয় তো নারী। ভালো করে তাকালে দেখা যাবে, এই দেশে এখন নারীরা বয়সের বিবেচনাহীনভাবে অনিরাপদ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তা, গণপরিবহন এমনকি ঘর—যেকোনো জায়গায় সে নির্যাতিত হতে পারে। তাকে হত্যা করা হতে পারে। তার গায়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হতে পারে। তার সঙ্গে যা ইচ্ছা তা-ই করা হতে পারে। এমনকি আড়াই বছরের শিশু হলেও তার কোনো নিস্তার নেই।

এটা একটা প্রতিষ্ঠিত কথা, যে দেশে নারী ও শিশুরা অনিরাপদ, সেই দেশে কেউই নিরাপদ নয়। অর্থাৎ রাষ্ট্র হিসেবে মুখ্য শর্তটিই পালনে ব্যর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ। আর এই ব্যর্থতা আরও বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে, যখন এর নাগরিকেরা তা চিহ্নিত করতে পারে না, বা চিহ্নিত করতে পারলেও চুপ করে থাকে। এই ব্যর্থতা স্বীকার না করে মধ্যম আয়ের এই রাষ্ট্র যখন মাতে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নিয়ে এবং সেই মাতামাতিতে অবলীলায় যোগ দেয় সমাজের নানা স্তরের মানুষ, তখন ডি এল রায়ের গানের ওই লাইনের অন্য অর্থটিই সামনে আসে বেশি করে, যা কুঞ্চিত করে দেয় নিজেকে ভেতরে-ভেতরে। যখন মেয়ের হত্যার বিচার চেয়ে কোনো বাবাকে একা ফেস্টুন হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, যখন নুসরাত প্রতিবাদ করে একা একা মরে যান, যখন তনু-আফসানা-ত্বকী হত্যার বিচারের দাবি পথ থেকে ক্রমে অপসৃত হয়ে যায়, যখন আমাদের সামনে বরাবরই মজুত থাকে প্রতিবাদ জানাবার অতি-মোক্ষম কার্যকারণ, যখন এই অঘটনের সরবরাহ থামে না কখনো, তখন নাগরিক প্রতিবাদের ঢংটিকে বড় বেশি প্রকল্পিত, বড় বেশি মেকি মনে হয়।

ফজলুল কবির: সাংবাদিক


Spread the love

Leave a Reply