কিস্তি-১: স্বাধীন বিচার ব্যাবস্থার উপর রাষ্ট্র পক্ষের অযাচিত হস্তক্ষেপ, ন্যায়বিচারের পরিপন্থী

Spread the love

আমরা সবাই কম বেশী এই কথার সাথে পরিচিত যে বিচারকের কুরসি অত্যন্ত পবিত্র, আর ন্যায় বিচারকের পুরস্কার আল্লাহর বিশেষ জান্নাত। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড না, সুশিক্ষা জাতির মেরুদন্ড, একটি সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠী পারে একটি দেশকে উন্নতির স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে দিতে। আর একটি দেশ বা জাতি কতটা উন্নত তা ওই দেশের সংস্কৃতি দেখেই বুঝা যায়। আবার একটি দেশকে ধ্বংস করতে হলে ওই দেশের বিচার, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে নষ্ট করলেই যথেষ্ট। মূল কথায় আসা যাক।পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন ও শোষণ থেকে মুক্তির আশায় ও নেশায় লক্ষাধিক প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীন মানচিত্রের অভ্যুদয়, যে রঙিন নতুন সূর্য্যের আগমন ঘটে তা ছিলো এক অসম্ভব সম্ভাবনাময় একটি জনপদ যার রয়েছে মানুষ সম্পদ, নদী সম্পদ, বনজ সম্পদ, কৃষিজ সম্পদ, পাহাড় সম্পদ, এবং পর্যটনে আকর্ষণীয় নানা অঞ্চল, একটি আশা, একটি ভালোবাসা, একটি স্বপ্ন। কিন্তু দুৰ্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে, অপরিপক্ক ও ক্ষমতালিপ্সু নেতৃত্বের জন্য, বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী পরিকল্পনার অভাবে সম্ভাবনাময়ী একটি দেশ ক্রমমান্নয়ে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে।বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকেই বিচার, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, কখনোই স্বাধীন, কল্যানকর বিচার ও শিক্ষা ব্যাবস্থা যেমন ছিলো না ঠিক তেমনি সংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব বা অবক্ষয় ছিলো বরাবর। তবে বর্তমান সময়ে এই ৩টি কারণ বিচার, শিক্ষা ও সংস্কৃতির অবক্ষয় দ্রুততর হয়েছে! আমার-আপনার প্রিয় দেশটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে একটি মহল। আমার ৩টি কিস্তিতে আলোচনা করবো কিভাবে এই ৩টি বিভাগ চরম দুর্দশাগ্রস্থ হলো এবং এ থেকে পরিত্রানের উপায় বা কি?

বিচার বিভাগে অপর্যাপ্ত বাজেট, আধুনিক কোর্ট রুমের অভাব, দক্ষ জনবলের অভাব, মামলার জটিলতা, পাহাড় পরিমান প্রায় ৩০ লক্ষ পেন্ডিং মামলা, অপ্রতুল বিচারকের সংখ্যা, মামলার দীর্ঘসূত্রিতাসহ স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা পরাধীনতার আঁচলে মোড়া, বিচার ব্যবস্থার উপর সরকারের অব্যাহত নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ফরমায়েশি রায়, রাজনৈতিক পরিচয়ে বিচারক নিয়োগ, এজলাসে মারপিট, বিচারককে দিয়ে নিজের মত বা নিজের প্রয়োজনে রায় লিখানো, নিপরাধকে রাজনৈতিক কারণে হয়রানি ও জামিন না দেয়া, ব্যাক্তির শতাধিক মামলাকে ঝুলিয়ে রাখা বা বিচার না করে দীর্ঘসূত্রিতা করা, বিচারকরা স্বাধীন মতামত বা রায় প্রকাশে অক্ষম বনে যাওয়া, বিদেশ থেকে রায় লিখানোর নজির, বিচারক দলীয় লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে তার পেশাগত শপথ ভুলে গিয়ে সরকারের স্বার্থ হাসিলের জন্য ন্যায় বিচারকে থোড়াই জ্ঞান করা যেন বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যেমন ধরুন- হাবিবুন্নবী সোহেলের উপর ৪৫০ এর উপর মামলা, সাগর রুনির মামলার তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার তারিখ ১০০ বারের মতো পিছানো, সময়ক্ষেপণ করা, রাষ্ট্র পক্ষ কর্তৃক প্রতিবেদন, আলামত এবং পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটানো, সাক্ষীকে আদালত থেকে তুলে নেয়া, জামিনে থাকার পরেও গ্রেফতার করা, জামিন পাওয়ার পরে মুক্তি না দিয়ে রাষ্ট্র পক্ষের নতুন মামলাকে এন্টারটেইন করা, আবার জেলগেট থেকে পুনরায় গ্রেফতার করলেও রাষ্ট্র পক্ষকে একাউন্টেবল না করা, নানা কায়দা কৌশল, ঘুষ-দুর্নীতি এবং তদবিরের মাধ্যমেও ন্যায়বিচারকে বিঘ্নিত করা; আইনজীবীর মুখ থেকে মামলায় রেমিডি দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি কোনো স্বাধীন বিচার ব্যাবস্থার লক্ষণ হতে পারে না। Justice delayed is justice denied (বিলম্বিত বিচার, বিচার অস্বীকারেরই নামন্তর)। তাইতো জেল, জুলুম, বিনা বিচারে হত্যা, গুম, ধর্ষণ, ক্ষোভ, অবিশ্বাস, পরস্পরকে শত্রু জ্ঞান করা, কথায় কথায় মারপিট সংঘর্ষকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের বসবাস করতে হচ্ছে।রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় বিভাজন দিন দিন প্রকট হচ্ছে, আর নিজের পক্ষে বা পছন্দ মতো কোনো কিছু না হলেই অন্যকে শত্রু পক্ষ বানিয়ে ফেলা হচ্ছে!

আপনারা নিশ্চয়ই আদালত প্রাঙ্গনে দেখেছেন ভিক্টিম বা আহত পরিবারের অসহায়ত্বের কথা, স্বজনেরা প্রকাশ্যেই বলছেন, আমরা বিচার চাই না। কার কাছে বিচার চাইব। বিচার চেয়ে কী হবে। তাঁরা সবাই বিচারের ভার আল্লাহ হাতে ছেড়ে দিয়েছেন কারণ বিচার চাইতে গেলে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়, কাজকারবার ফেলে রেখে শুধু আদালত প্রাঙ্গনে দৌড়াতে হয়, বিপুল অর্থ খরচ হয়, প্রতিপক্ষের চক্ষশূল হতে হয়, পড়তে জীবন নিয়ে হুমকির মুখে ইত্যাদি ইত্যাদি তাই দুনিয়াতেই ক্ষতিগ্রস্তরা বা ভিকটিমরা আল্লাহর কাছে বিচারের ভার এভাবেই ছেড়ে দিচ্ছে। আবার সাম্প্রতিক সময়ে হাইকোর্ট ডিভিশনের এক বিচারক রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবীকে বলেই বসলেন যে-“আপনারাতো দেশটাকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন”। অন্যদিকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি তার মেয়াদের শেষ কার্যদিবসে আয়োজিত এক বিদায়ী সংবর্ধনায় বললেন “সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বিচার বিভাগকে রক্ষা করা বিচারক, আইনজীবী ও রাষ্ট্রের প্রত্যেক দায়িত্বশীল নাগরিকের দায়িত্ব”।এই বক্তব্যগুলোই যথেষ্ট বাংলাদেশের পরাধীন বিচার ব্যাবস্থাকে অনুধাবনের জন্য।বিচার না চাওয়ার সংস্কৃতি, ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়া, বিচারের নাম প্রহসন করা, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রবল খবরদারি একটি দেশের স্বাধীন বিচার ব্যাবস্থাকে পুরোপুরি অকার্যকর বা ভেঙে পড়ার কথাই বলছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও আমরা একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচার ব্যবস্থা পাইনি যে কারণে সাধারণ জনগণ সমস্বরে বলছে বর্তমান বিচার ব্যাবস্থা স্বাধীন নয় এবং এর উপর তাদের কোনো ভরসা নেই।
আর যেহেতু বিচার বিভাগ স্বাধীন নয় এবং ন্যায় বিচার পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই, তাই মানুষের মধ্যে বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা জন্মাচ্ছে, বিচারের প্রতি অনীহা জন্মাচ্ছে, বিচার না দেয়ার বা চাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, পারস্পরিক আস্থাহীন, সম্পর্কহীন নির্মম এক বিভাজিত সমাজ তৈরি হচ্ছে। বিচার ব্যবস্থার ওপর থেকে সাধারণ মানুষের আস্থা একেবারেই উবে যাচ্ছে। থানা, পুলিশ, আদালত—সর্বোপরি সরকারকে কেউ আর বিশ্বাস করছে না। মানুষ যখন ক্রমাগত ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হবে তখন তাদের মধ্যে আইনকে নিজ হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতাও বৃদ্ধি পাবে। অপরাধ ও অন্যায় করার পরেও যখন রাজনৈতিক বিবেচনায় ও পরিচয়ে শাস্তি হয় না, বা মুক্তি পেয়ে যায় তখন অপরাধীর মধ্যে নতুন ও দ্বিগুন মাত্রায় অপরাধ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে ভিক্টিম ন্যায় বিচার বঞ্চিত হয়ে আল্লাহর উপর বিচারের ভার ছেড়ে দেয় অথবা সাহস ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, যদি কখনও সুযোগ পায়, তাহলে সেও প্রতিশোধ নিবে, সহজেই হয়ে উঠে প্রতিশোধ পরায়ণ।আর এইভাবে চলতে থাকলে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে পড়বে, হানাহানি বাড়বে, হত্যা, জুলুম, নির্যাতন, লুটতরাজ বাড়বে, সমাজ থেকে শান্তি দূরীভূত হবে এবং আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র অধরাই থেকে যাবে।

নিশ্চয়ই আপনাদের মার্টিন লুথার কিংয়ের ওই কথা “Injustice anywhere is a threat to justice everywhere, (যে কোন জায়গায় অবিচার সর্বত্র ন্যায়বিচারের জন্য হুমকিস্বরূপ)” টি মনে আছে। আমরা সবাই বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা চাই। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার বাহিরে থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য শোরগোল তোলে কিন্তু পরক্ষনে আবার ক্ষমতায় গেলে দেখা যায় তারাও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার উপর নব্য আক্রমণ করে, আর এই খেলা চলছে স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকে যেন “যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ”। অথচ আমরা সবাই মানি ও জানি যে বিচার বিভাগ ব্যর্থ হলে বা আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ থেকে বিচ্যুত হলে রাষ্ট্র ও নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। আধুনিক, স্বাধীন ও কল্যানকর বিচার ব্যাবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারের স্বদিচ্ছাই যথেষ্ট। তাই আজকের সরকারকেই একটি কার্যকর স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা উপহার দেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে।

লেখকঃ ব্যারিষ্টার ওয়াহিদ মুহাম্মদ মাহবুব
১৩/১০/২০২৩, লন্ডন।


Spread the love

Leave a Reply