বাংলাদেশে রিজার্ভের হিসাবে বড় রকমের ঘাটতি

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ বাংলাদেশে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে, প্রকৃত রিজার্ভ তার তুলনায় অনেক কম হবে বলে ধারণা করছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি।

শনিবার ঢাকায় ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২২-২৩: তৃতীয় অন্তর্বতীমূলক পর্যালোচনা’ শীর্ষক আলোচনায় এই মন্তব্য করেছেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, দেশে বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ২৯ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার।

তিনি বলেছেন, ‘’সরকারের হাতে ৩০ বিলিয়ন ডলার আছে বলে বলা হচ্ছে, আমাদের ধারণা আমরা রিজার্ভের যে হিসাবটি পাই, সেটা একধরনের আপাত হিসাব। কি পরিমাণ বকেয়া রয়েছে, যার পেমেন্ট করতে হবে, সেগুলোর পেমেন্ট ঠিকমতো করতে হলে নেট রিজার্ভে এখন যেটি আসছে (তুলে ধরা হচ্ছে), সেখানে বড় রকমের ঘাটতি রয়েছে।‘’

তিনি জানান, এই ঘাটতির কারণে আগে থেকেই বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির রি-পেমেন্ট পিছিয়ে দেয়া হচ্ছে। সরকাররে তরফ থেকে তাদের অনুরোধ করা হয়েছে, এই মুহূর্তে তারা যেন বিদেশি মুদ্রায় পেমেন্ট না করে। বড় কোম্পানির রয়্যালটি এবং অন্যান্য পেমেন্ট পিছিয়ে দেয়া হচ্ছে। বেসরকারি কোম্পানির বিদেশি ঋণের কিস্তি পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।

‘’এগুলো যদি হিসাব করে, তাহলে সরকারের যে রিজার্ভ ২৩ বিলিয়ন ডলার নেট বলা হচ্ছে, সেটি আসলে আরও অনেক কম। সুতরাং আমরা আপাত যে হিসাব পাচ্ছি, প্রকৃত রিজার্ভটি আরও সংকট কালীন। সেখানে যদি উপযুক্ত রকমের উন্নতি না হয়, তাহলে আইএমএফ বা এডিবির পরবর্তী কিস্তিগুলো না এলে বৈদেশিক পেমেন্টের ক্ষেত্রে সংকট চলতেই থাকবে,’’ বলেন ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

সম্প্রতি রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩০ কোটি ডলার বকেয়া থাকার কারণে ছয়টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে তেল দিতে চায় না, কারণ বাংলাদেশ পেমেন্ট করতে পারছে না। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশের ৩০ কোটি ডলার বকেয়া পড়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন,দেশে যথেষ্ট রিজার্ভ রয়েছে। তারপরেও কেন বকেয়া পরিশোধ করতে পারছে না সরকার?

একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, ‘’আমার মনে হয়, এখানে যে ২৪.৪৬ বিলিয়ন ডলার নেট রিজার্ভ জুন মাসে রাখতে হবে বলে বাধ্যবাধকতা আছে, আমার ধারণা এই কারণে খুবই সতর্কতার সাথে রিজার্ভ ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই জন্য টাকা ছাড়ের ব্যাপারে কিছুটা…এগুলো তো দিতে হবেই আমাদের। বিদ্যুৎ জ্বালানি অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো ডেফার্ড পেমেন্ট, আমরা এনেছি, অনেক ক্ষেত্রে বকেয়া পড়ে গেছে।‘’

অর্থনীতির সংকট আরও বড় হচ্ছে

বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পরিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, বাংলাদেশে যে সামগ্রিক অর্থনীতির যে সংকট রয়েছে, তা আস্তে আস্তে আরও বড় হয়ে ব্যষ্টিক অর্থনীতিকে আঘাত করতে শুরু করেছে।

প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, আমরা দেখছি যে, আমাদের অর্থনীতি বর্তমানে যেভাবে এগোচ্ছে, সেখানে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ কঠিন কিছু সমস্যার মুখোমুখি রয়েছে। এর একটি হচ্ছে বাহ্যিক, আরেকটি অন্তর্নিহিত বা ভেতরের সমস্যা।‘’

বাহ্যিক কারণের মধ্যে রয়েছে করোনাভাইরাসের আঘাতের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়া, সে কারণে সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যত্যয়, আমদানির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ সমস্যার মধ্যে রয়েছে, অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতা, পূর্ণাঙ্গ নীতি না নেয়া, সুশাসনের ও সংস্কারের অভাব।

সিপিডি বলছে, বিভিন্ন ধরনের সাময়িক অর্থনীতির সূচক কোনটাই এই মুহূর্তে ভালো অবস্থায় নেই।তার বিপরীতে সরকার যেসব নীতিগত ব্যবস্থা নিচ্ছে, তার কোনটাই আসলে কাজ করছে না।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, ‘’আমাদের ধারণা সরকার যদি এই ধারায় সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে আগামীতে এগোতে চান, তাহলে সরকার আটকে যাবে এবং সম্ভবত সামষ্টিক অর্থনীতির সংকটগুলো আরও ঘনীভূত হবে।‘’

সিপিডি বলছে, রাজস্ব আয়, মূল্যস্ফীতি কমানো, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচী, রেমিট্যান্স আনা, এক্সটারনাল সেক্টরে এক্সচেঞ্জ রেট ম্যানেজমেন্ট- সবগুলো ক্ষেত্রে সরকার যে ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে, তাতে খুব বেশি কাজ করছে না।

কেন কাজ করছে না, সেটা সরকারের মূল্যায়ন করে দেখা দরকার বলে তারা পরামর্শ দিয়েছে।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ”আমাদের মনে হয়েছে, অর্থনীতি যে সংস্কার বিমুখিতা রয়েছে, সেজন্যই এটা কাজ করছে না। যতদিন পর্যন্ত অর্থনীতি সংস্কারের কুইনাইন খেতে না পারবেন, ততদিন পর্যন্ত এই অবস্থা থেকে উত্তরণ হওয়া খুবই জটিল।‘’

‘’সিভিল সোসাইটি, আইএমএফের পক্ষ থেকে যেসব সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, তার চেয়েও বাড়তি উদ্যোগ নেয়া দরকার। এজন্য আগামীতে যে সরকারই আসবেন, তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অর্থনৈতিক সংস্কার মূল এজেন্ডা হিসাবে থাকা দরকার। নাহলে ২০২৪ সালে বড় রকমের সংকটের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে,’’ তিনি বলেন।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, এমন একটা সময় ২০২৩-২৪ সালের বাজেট হচ্ছে, এক কথায় এই সময়কে অভূতপূর্ব পরিস্থিতি বলা যাবে। আমাদের জিডিপির যে প্রবৃদ্ধি যে এ বছরের জন্য প্রাক্কলন করা হচ্ছে ৬.০৩ শতাংশ, কোভিডের দুই বছর বাদ দিলে এটা গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

এপ্রিল পর্যন্ত আমাদের মূল্যস্ফীতি ৮.৬ শতাংশ, এটা গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বিদেশি রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ধরলেও এটা সাত বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এমন প্রেক্ষাপটেই এই অর্থবছর শেষ করে নতুন অর্থবছরের বাজেট করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেও অর্থনীতিবিদরা সতর্কবার্তা জানিয়েছিলেন। সেটাই এখন প্রমাণিত হয়েছে। সেগুলো সেই সময় বিবেচনায় রাখা হলে অর্থনীতি হয়তো আরেকটু সমন্বয়ের সুযোগ পেতো।

পাচারের অর্থ রেমিট্যান্স হিসাবে ফিরে আসছে?

একসময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসলেও গত ১০ মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসছে। এটাকে ‘অস্বাভাবিক’ বর্ণনা করে এর মাধ্যমে পাচারের অর্থ রেমিট্যান্স আকারে দেশে ঢুকছে কিনা, সেই প্রশ্ন তুলেছে সিপিডি।

সিপিডির পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘’আমরা জানি, আমাদের দেশে বেশিরভাগ রেমিট্যান্স কোথা থেকে আসে। গত ১০ মাসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ৯ দশমিক ২২ লাখ মানুষ গেছে। সেখান থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী রেমিট্যান্স আসছে না। লোক যাওয়া ও রেমিট্যান্সের মধ্যে মিসম্যাচ হচ্ছে। এতদিন সৌদি আরব থেকে বেশি রেমিট্যান্স এলেও যুক্তরাষ্ট্র এখন সে জায়গা দখল করেছে।‘’

গত ১০ মাসে সৌদি আরব থেকে ৩.০৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ৩.০৫ বিলিয়ন ডলার। এর আগের অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২.৮৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। সৌদি আরব থেকে এসেছিল ৩.৮৬ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘’এর একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে এমন – যেখান থেকে টাকাটা পাচার হয়েছে, সেটা আবার রেমিট্যান্স আকারে দেশে ফেরত আসছে। রেমিট্যান্সের ওপর যে আড়াই শতাংশ ইনসেন্টিভ বা সাবসিডি দেওয়া হচ্ছে, সেটার সুযোগ নেওয়া হচ্ছে। কর্তৃপক্ষকে আরও গভীরে গিয়ে বিষয়টির অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।‘’

তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।


Spread the love

Leave a Reply