ব্রিটেনের স্কুলে মারধোর যেদিন বন্ধ হলো

Spread the love

বাংলা সংলাপ ডেস্কঃইউরোপের মানবাধিকার আদালত ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক ঐতিহাসিক রায় দেয়। এই রায়ে ব্রিটেনের সব সরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের মারধোর নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

স্কটল্যান্ডের দুই ছাত্রের মা আদালতে এই বিষয়ে মামলা দায়ের করেছিলেন। এই দুই ছাত্রের একজন হলেন অ্যান্ড্রু ক্যাম্বেল।

তার মতোই হাজার হাজার ছাত্র যারা স্কটিশ স্কুলগুলো থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন, তাদের প্রায় সবার গায়েই ছিল বেত্রাঘাতের চিহ্ন।

আর স্কটল্যান্ডে এই কাজটি করা হতো ‘টওজ’ নামের চামড়ার বেল্ট দিয়ে।

এই বেল্টের প্রান্তটি দুই বা তিন ভাগে বিভক্ত থাকতো। ফলে এই বেল্ট যখন শিক্ষার্থীদের দেহে আঘাত করতো তখন সেটা চামড়ায় বসে যেত, কিন্তু চামড়া কেটে যেত না।

উনশিশো আশির দশকের এক জরিপে জানা যায়, প্রতি তিন জন ছাত্রের মধ্যে একজন এবং প্রতি ১২ জন ছাত্রীর মধ্যে একজন স্কুলে পিটুনির শিকার হয়েছে এবং জনপ্রতি গড়ে ১৪ দিন ধরে তারা শিক্ষকের মার সহ্য করেছে।

অ্যান্ড্রু ক্যাম্বেল বলছেন, ‘টওজ’ ছিল ভয়াবহ এক শাস্তিদানের অস্ত্র। ব্রিটেনের স্কুলে মারধর এখন সম্পুর্ন নিষিদ্ধ।
তিনি বলছেন, “এই বেল্ট যখন হাতের ওপর আছড়ে পড়তো তখন সেটা বিকট আওয়াজ করতো। হাতের ওপর এটা এমন জ্বালা ধরিয়ে দিতো, যা সহ্য করা কঠিন।”

স্কটল্যান্ডের স্কুলে ছাত্রদের শাস্তি দেয়া হতো 'টওজ' নামের চামড়ার বেল্ট দিয়ে।
স্কটল্যান্ডের স্কুলে ছাত্রদের শাস্তি দেয়া হতো ‘টওজ’ নামের চামড়ার বেল্ট দিয়ে।

অ্যান্ড্রু ক্যাম্বেল নিজে এই বেল্টের শিকার হননি। কিন্তু তিনি এবং তার সহপাঠীরা এই বেল্টের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতেন।

এই শাস্তিদানের এক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলছিলেন, “একবার আমরা ক্লাসে বসে আছি। হঠাৎ করেই ক্লাসের সবাই একেবারে নীরব হয়ে গেল। শুনতে পেলাম পাশের ক্লাসের শিক্ষক কোন এক ছাত্রকে খুব বকাঝকা করছিলেন। একটু পরে শোনা গেল সপাৎ সপাৎ আওয়াজ। ভয়ে আমরা পাথর হয়ে গেলাম।”

তিনি বলছিলেন, বাড়িতে ফিরে তিনি ঘটনাটি তার মা-বাবাকে জানিয়েছিলেন।

ব্রিটেনে ১৯৭০ সালের সময়টাতে ইংল্যান্ড, ওয়েলস ও স্কটল্যান্ডের স্কুলগুলিতে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তিদান করা বৈধ ছিল।

কিন্তু ইউরোপের স্কুলগুলিতে এটা তখন অবৈধ।

সে সময় অনেক ব্রিটিশ অভিভাবক এবং শিক্ষকই মনে করতেন যে ছেলেমেয়েকে ‘মানুষ’ করতে হলে এর প্রয়োজন রয়েছে। স্কুলের নিয়মকানুন ঠিক রাখতে হলে এটার প্রয়োগ চলতে পারে।
কিন্তু অনেকেই স্কুলের কোমলমতি শিশুদের কোন ধরনের মারধরের ঘোর বিরোধী ছিলেন।

তাদের যুক্তি: যে মুহূর্তে একজন শিক্ষক তার ছাত্র বা ছাত্রীকে পিটুনি দেয়ার জন্য হাতে বেত তুলে নেন, সেই মুহূর্তে তিনি নিজে শিক্ষক হিসেবে পরাজিত হন।

অ্যান্ড্রু ক্যাম্বেলের বাবা ছিলেন একজন ডাক্তার এবং মা সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করতেন।

দু’জনেই স্কুলে শারীরিক শাস্তির ঘোর বিরোধী। তারা চাইতেন কোনভাবেই তাদের সন্তানের গায়ে কেউ যেন হাত না তোলে।

অ্যান্ড্রুর বড় ভাই গর্ডনকে যখন ভিন্ন স্কুলে ভর্তি করার চিন্তাভাবনা শুরু হলো, মি. এবং মিসেস ক্যাম্বেল স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলেন এবং তাদের ছেলেকে কোনভাবেই মারধর করা হবে না, এই মর্মে লিখিত নিশ্চয়তা দাবি করলেন।

“আইনগত বিধানের কথা বাদ দিলেও শিক্ষা কর্তৃপক্ষ নীতিগতভাবেই এধরনের কোন লিখিত মুচলেকা দিতে রাজি হয়নি,” বলছিলেন অ্যান্ড্রু ক্যাম্বেল, “আমার মা-বাবা এরপর এ নিয়ে তদবির শুরু করলেন। তারা স্থানীয় কাউন্সিল, স্থানীয় এমপি — সবার কাছে দেন-দরবার শুরু করেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হোল না।”

অনেক অভিভাবক এবং শিক্ষকই মনে করতেন, ছেলেমেয়েকে ‘মানুষ’ করতে হলে এর প্রয়োজন রয়েছে।
উকিলের পরামর্শ নেয়ার পর তারা বুঝতে পারলেন যে ব্রিটেনের আইন ব্যবস্থায় এর কোন সুরাহা হবে না।

তাই তারা ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

এরপর ১৯৭৬ সালে গ্রেস ক্যাম্বেল, অ্যান্ড্রু ক্যাম্বেলের মা, এবং আরেকজন স্কটিশ ছাত্রের মা জেন কোস্যান্স ঐ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন।

অ্যান্ড্রু ক্যাম্বেল বলছেন, এই মামলা চলার সময় তার মা-বাবাকে কখনও কখনও বেশ উদ্বিগ্ন দেখা গেছে।

কারও কারও সাথে কথাবার্তা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল।

“আমাদের বাসা যে রাস্তায় সেই একই রাস্তায় থাকতেন আমার স্কুলের একজন শিক্ষক। মামলা দায়ের হওয়ার পর থেকে এই মহিলা জীবনে আমাদের পরিবারের কারো সাথে একটি কথাও বলেননি। এটা ছিল খুবই অবাক হওয়ার মতো ঘটনা।”

এই মামলা চলার সময় ক্যাম্বেল পরিবার নানা ধরনের হেনস্তার শিকার হন।

অ্যান্ড্রু ক্যাম্বেল বলছেন, মামলার অগ্রগতির সাথে সাথে তাদের ওপর সংবাদমাধ্যমের মনোযোগও বেড়ে যায়। এর জেরে তাদের নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।

একবার ঢিল মেরে বাড়ির জানালার কাঁচ ভেঙে দেয়া হয়। একবার আঁকিবুঁকি করে বাড়ির দেয়াল নষ্ট করা হয়।

দেয়ালে লেখা ছিল: এই বাড়িতে ‘বেল্ট বিরোধীরা থাকে।’
“আমরা বাইরে বেরুলে প্রায়ই মানুষের গালাগালি শুনতে হতো। আমাকে এবং আমার ভাইয়ের ওপর থুথু ছোঁড়া হতো।”

তিনি বলছেন, তার মা-বাবা সবসময় বলতেন তারা যেন কখনও দুষ্টুমি না করেন। কারণ তাহলে তাদের দেখিয়ে লোকে বলবে: এদের দেখুন, বাচ্চাদের শাস্তি না দিলে তার ফল কী হয়।

“ফলে আমরা যখন বড় হচ্ছিলাম তখন সবসময় আমাদের এই কথাটা মনে রাখতে হতো এবং ভাল ছেলে হয়ে থাকতে হতো।”

দীর্ঘদিন মামলা চলার পর ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মানবাধিকার আদালত তার ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে।

এতে বলা হয়, পিতামাতার সায় ছাড়া কোন শিশুকে প্রহার করা মানবাধিকার সনদের লঙ্ঘন।

সেই দিনটির কথা অ্যান্ড্রু ক্যাম্বেল পরিষ্কার মনে করতে পারেন।

“আমি ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছিলাম। হঠাৎ নিউজে দেখলাম আমার মা কথা বলছেন। আমার খুবই অবাক লাগছিল। আমার মনে আছে মামলায় জয়ের জন্য আমার মাকে খুবই গর্বিত দেখাচ্ছিল।”

স্কুল শিক্ষার্থীদের মারধরের বিরুদ্ধে গ্রেস ক্যাম্বেল এবং জেন কোস্যান্স যে আইনী লড়াই শুরু করেছিলেন, তা এই বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে অনেক সাহায্য করেছিল।

কিন্তু ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের ঐ রায়ের পরও স্কটল্যান্ডের সব স্কুল থেকে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করতে আরও আট বছর লেগে যায়।

যে বছর আদালতের রায় হয় সেই বছরই গ্রেস ক্যাম্বেলের স্ট্রোক হয়।

সাত বছর ভুগে ১৯৮৯ সালে তিনি মারা যান। তখন তার বয়স হয়েছিল ৪৭ বছর।


Spread the love

Leave a Reply