রোজার মাসে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি গাজার বাসিন্দারা

Spread the love

গত সোমবার, ১১ই মার্চ ভোর থেকে আরব বিশ্বে যখন মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়েছে, তখন গাজার বাসিন্দারা মুখোমুখি হয়েছেন এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার।

যে রমজান মাসে মুসলমানরা সারা দিন রোজা রাখেন, অর্থাৎ খাবার-পানি খাওয়া থেকে বিরত থাকেন, সেটি গাজাবাসীর সামনে দুর্ভিক্ষ হয়ে এসেছে।

গত পাঁচ মাস ধরে যুদ্ধের মধ্যে রয়েছেন গাজার বাসিন্দারা। বাস্তবিক অর্থে এখনো সেখানকার সব মানুষ এখন খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছেন।

‘’এখানকার মানুষজন ইতোমধ্যেই মাসের পর মাস জুড়ে অনাহারে থাকছে,’’ বলছিলেন গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের উপ-পরিচালক ড. আমজাদ ইলেইয়া।

‘’বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সারা শহর জুড়ে তারা খাবার খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু কোথাও পায় না,’’ তিনি বলছেন।

গত বছরের ৭ই অক্টোবর হামাসের হামলার পাল্টা জবাব হিসাবে ইসরায়েলের বোমাবর্ষণের ফলে গাজার খাদ্যের সব অবকাঠামো আর ক্ষেতখামার ধ্বংস হয়ে গেছে।

সাহায্য সংস্থাগুলো বলছে, সরবরাহ ট্রাকগুলো ঘিরে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর অতিরিক্ত তদারকির কারণে জনগণের কাছে সাহায্য পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে ।

গাজার একটি সহায়তা কেন্দ্রে খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে শিশুরা
গাজার একটি সহায়তা কেন্দ্রে খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে শিশুরা

বিশ্বে যে সংস্থাটি দুর্ভিক্ষের বিষয়ে ঘোষণা দিয়ে থাকে, সেই ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) জানিয়েছে, এই সোমবার নাগাদ ১১ লাখ মানুষ – যা গাজার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক – ইতোমধ্যেই অনাহারে থাকছে।

বাকি যারা আছে, তারাও জুলাই মাস নাগাদ দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়বে।

খাদ্যের এই সংকট সবচেয়ে বেশি গাজার উত্তরাঞ্চলে। গত বছরের রমজানের মতো এবার আর তারা সেহরিতে পেট ভরে খেতে পারছেন না বা ইফতার করে ক্ষুধা মেটাতে পারছেন না।

রমজানে যেখানে সড়কগুলো নানাভাবে সজ্জিত থাকত, ড্রাম বাজত বা উদযাপনের নানা আয়োজনে ভরে থাকত, সেখানে এখন ধ্বংস, মৃত্যু আর খাবার খোঁজার প্রতি দিনের লড়াই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আটা বা গমের দাম পাঁচগুণ বেড়েছে।

‘’গত রমজানের কথা মনে আছে, অনেক ভালো ভালো খাবার ছিল … শরবত, খেজুর, দুধ … আপনি যা খেতে চান, সব কিছুই ছিল’’, বলছিলেন ৫৭ বছর বয়সী একজন মা নাদিয়া আবু নাহেল, যিনি ১০টি শিশু নিয়ে একটি যৌথ পরিবারের দায়িত্বে আছেন।

‘’এই বছরের সাথে তুলনা করলে এটা যেন বেহেস্ত আর দোজখের পার্থক্যের মতো’’, তিনি বলছেন।

‘’এখন শিশুরা রুটির একটা টুকরার জন্য আকাঙ্ক্ষা করে থাকে, এই খাবারটাও তাদের কাছে এখন স্বপ্নের মতো। তাদের হাড়গোড় দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাদের মাথা ঘোরে, হাঁটতে কষ্ট হয়, সবাই শুকিয়ে যাচ্ছে”, বলছেন নাদিয়া আবু নাহেল।

দাতব্য সংস্থা পভার্টি চ্যারিটি কেয়ারের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে উত্তর গাজা এলাকায় অপুষ্টি বা পানিশূন্যতায় অন্তত ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে ২৩টি শিশু রয়েছে।

যদিও উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসকদের মতে, এই সংখ্যা আরও বেশি বেশি হবে।

আল-শিফা হাসপাতালে অপুষ্টিতে ভোগা যে শিশুদের এই রমজান মাসে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে একটি শিশু ছিল ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে।

আরেকটি দুগ্ধপোষ্য শিশুর বয়স ছিল মাত্র চার মাস, যার মা কিছুদিন আগে মারা গেছে, কিন্তু এখন তাকে দুধ কিনে দেওয়ার মতো কেউ নেই। ১৮ বছর বয়সী আরেকটি মেয়ে রয়েছে, যে এর মধ্যেই মৃগী রোগে ভুগতে শুরু করেছে।

‘’সে এর মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তার জন্য দরকারি কোনও ওষুধই আর খুব বেশিদিন পাওয়া যাবে না। আর তার পরিবারের খাবারও নেই’’, ড. ইলেইয়া বলছেন।

‘’শেষ দিকে তার শরীর খুব ক্ষীণ হয়ে পড়েছে, শুধুমাত্র তার হাড় আর চামড়া দেখা যাচ্ছে, সেখানে কোন চর্বি নেই।’’

আল-শিফা হাসপাতালে তার তত্ত্বাবধানে বিছানায় শুয়ে রয়েছে ১৬ বছর বয়সী রাফিক দোঘমাউশ। তার শরীরের হাড় দেখা যাচ্ছে আর তার একটি পা হাঁটু থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। তার শরীরের সাথে একটি কোলোস্টমি ব্যাগ লাগানো ছিল।

‘’আমার সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে’’, বলছিল রাফিক।

প্রতিটি শব্দের মাঝে শ্বাস নেওয়ার জন্য ধীরে ধীরে সে কথা বলছিল।

“আমি এতটাই দুর্বল যে আমি আমার শরীরকে একপাশ থেকে অন্য দিকে সরাতে পারি না। আমার চাচাকে এটা করে দিতে হয়!”, জানায় রাফিক।

তার চাচা মাহমুদ জানিয়েছেন, তাদের বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় রাফিক এবং তার ১৫ বছর বয়সী বোন রাফিফ মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল।

ওই হামলায় তাদের পরিবারের ১১ জন সদস্য মারা গেছে। নিহতদের মধ্যে আছে তাদের মা, চার ভাই-বোন এবং ভাগ্নে-ভাগ্নি।

তিনি জানালেন, বিমান হামলায় আহত হওয়ার আগে থেকেই রাফিক অপুষ্টিতে ভুগছিল।

‘’খাওয়ার জন্য আমরা কোনও ধরনের ফলমূলই পাই না। না আপেল, না পেয়ারা … কোনও মাংসও পাওয়া যায় না। বাজারে যে সব খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায়, সব কিছুর দাম অনেক চড়া’’, তিনি বলেছেন।

বিমান হামলায় রাফিফের পা ভেঙ্গে যায়, যা এখন এক সাথে জোড়া দিয়ে রাখা হয়েছে।

সে বলছিল হাসপাতালের কর্মীদের কাছে খাওয়ার মতো কোনও ফল বা সবজি চেয়েছিল সে, কিন্তু ‘’তারা কোনও কিছু দিতে পারেনি’’।

অথচ আগে রমজান একটি বিশুদ্ধ আনন্দের সময় ছিল, রাফিফ বলছিল, “এখনকার তুলনায় স্বর্গ!”

“এটি সত্যিই সুন্দর সময় ছিল। কিন্তু সেই সময়গুলো আর ফিরে আসবে না। আমাদের জীবনের সেরা সময়গুলো হারিয়ে গেছে!”

আল-শিফা হাসপাতালের চিকিৎসকরা অপুষ্টিতে ভোগা অনেক শিশুকে আরও উত্তরের হাসপাতাল কামাল আদওয়ানে পাঠিয়ে দিয়েছেন, কারণ সেখানে শিশুদের জন্য উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সেখানেও শিশুদের মৃত্যুর হার অনেক বেশি।

কামাল আদওয়ান হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ড. হুশাম আবু সাফিয়া জানিয়েছেন, গত চার সপ্তাহের মধ্যে অপুষ্টি বা পানিশূন্যতার কারণে হাসপাতালে ২১টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এখনও সেখানে ১০টি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

‘’এসব শিশুকে রক্ষা করতে না পেরে নিজেকে আমার অসহায় লাগে। এটা কষ্টকর আর লজ্জাজনকও,’’ বলছেন ড. সাফিয়া।

‘’আমার সহকর্মীদের জন্যও আমার একই রকম অনুভূতি হয়, যারা নিজেরাও ঠিক মতো খেতে পায় না। অনেক দিন তাদের খালি পেটেই কাজ করতে হয়।’’

তিনি বলেন, ‘’ইসরায়েল একটি ‘অনাহারের যুদ্ধ’ শুরু করেছে।’’

“ইচ্ছাকৃতভাবে শিশুদের খাদ্য থেকে বঞ্চিত করা, তাদের অনাহারে হত্যা করা – বিশ্বের এমন কোনও আইন নেই যা দখলদারদের এটি করার অনুমোদন দেয়”, বলছিলেন তিনি।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান জোসেফ বোরেলও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজাবাসীকে ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহারে রাখার অভিযোগ করেছেন।

সোমবার তিনি বলেছেন, “গাজায় আমরা আর দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে নেই, আমরা দুর্ভিক্ষের মধ্যে আছি।”

“এটা অগ্রহণযোগ্য। অনাহারকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইসরায়েল দুর্ভিক্ষকে উস্কে দিচ্ছে,” তিনি বলেছেন।

ইচ্ছাকৃতভাবে গাজাবাসীকে অনাহারে রাখার অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইসরায়েল।

তারা বরং জাতিসংঘকে দোষারোপ করে বলেছে, ত্রাণ সরবরাহ করার ক্ষেত্রে নানা রকম সমস্যা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে হামাস এই ধরনের সমস্যা বেশি তৈরি করছে বলে তারা দাবি করেছে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত সপ্তাহে গাজাবাসীর ক্ষুধার্ত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

“আমাদের কাছে এমন কোনও তথ্য নেই এবং আমরা নিবিড়ভাবে এই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি,” মিডিয়া আউটলেট পলিটিকোকে তিনি বলেছেন।

কিন্তু গাজাবাসী আসলেই অনাহারে রয়েছে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক জ্যেষ্ঠ মুখপাত্র আবির ইতেফা বলেছেন, “তথ্যপ্রমাণেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায়। আইপিসির পঞ্চম দফার কর্মসূচির অধীনে ১১ লাখ শিশু তালিকাভুক্ত রয়েছে – এর মানে হচ্ছে সেখানে বিপর্যয়কর খাদ্য সংকট চলছে।”

“সেখানে থাকা দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি শিশু তীব্রভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে। এর মানে তারা মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে।”

গত শুক্রবার দাতব্য সংস্থা ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের সরবরাহ করা ২০০ টন খাবার গাজা উপকূলে নতুন তৈরি করা জেটিতে পৌঁছেছে।

ধ্বংস হওয়া ভবনগুলোর ইট-কাঠ দিয়ে এই জেটিটি তৈরি করেছে একটি দাতব্য সংস্থা।

আশা করা হচ্ছে এটি উত্তর ও মধ্য গাজার তীব্র খাদ্য ঘাটতি দূর করবে এবং রমজানের বাকি সময়ে কিছুটা স্বস্তি আনবে।

কিন্তু দাতব্য কার্যক্রমে জড়িত সংস্থাগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে যে, বেসামরিক নাগরিকদের জন্য যে মানবিক দায়িত্ব পালন করা উচিত, ইসরায়েল তা করছে না। বরং দাতব্য সংস্থা এবং অন্যান্য দেশগুলোকে সেই শূন্যতা পূরণে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ-এর যোগাযোগ বিষয়ক পরিচালক জুলিয়েট তোউমা বলেন, “একটি দখলকারী শক্তি হিসেবে, ইসরায়েল সব বাসিন্দার চাহিদা পূরণ করতে বা মানবিক সহায়তা প্রদানের সুবিধা দিতে বাধ্য। কিন্তু তারা তা করছে না। যতটা করা উচিত, তা করছে না।”

শুক্রবার যখন ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের খাদ্য বহনকারী নৌযানটি গাজা উপকূলের কাছাকাছি আসছে, সেই সময় ছয় সন্তানের পিতা খালেদ নাজি মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহতে তাদের বাড়ির ধ্বংসাবশেষে বসে স্ত্রীকে রাতের খাবার প্রস্তুত করতে সাহায্য করছিলেন।

“আমাদের এই সাহায্য দরকার,” মিঃ নাজি বলছেন। “তারা মানবিক সহায়তার কথা বলে কিন্তু আমরা আসলে কিছুই পাই না।”

গাজার আরও অনেকের মতো, মিঃ নাজি এবং তার পরিবার রমজান পালন করার চেষ্টা করছেন।

“আমরা আল্লাহর জন্য রোজা রাখছি কিন্তু এই বছর আমরা এটি আনন্দের সঙ্গে করতে পারছি না,” তিনি বলেছিলেন।

“শুধু সেহরি নয়, যে মুহূর্তে আমরা রোজা ভঙ্গ করি, তখন যে রীতিনীতি আমরা সাধারণত অনুসরণ করি, এর কোনও সময়েই সেটা আমরা করতে পারছি না।”

“আমরা আমাদের বাচ্চাদের পোশাক পরিয়ে তাদের নামাজে নিয়ে যাচ্ছি না। আমরা তাদের আমাদের বিশ্বাস সম্পর্কে শিক্ষা দিচ্ছি না।”

“আপনি কেবল আপনার সন্তানকে সামান্য কিছু খাওয়াবেন এবং সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকবেন যে, যে কোনও সময় আপনার মাথায় একটি বোমা পড়তে পারে।”

সূর্যাস্তের সময়, মি. নাজি ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটি কংক্রিটের স্ল্যাবের উপর কম্বল বিছিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে বসে ছিলেন।

তারা ইফতারের জন্য অল্প কিছু টাটকা খাবার সংগ্রহ করেছিলেন। আগের কয়েকদিন তাদের ইফতারের জন্য কিছুই ছিল না।

“গাজা উপত্যকায় আমাদের জন্য এখন যে অবস্থা, তাতে মৃতদেরকেও আমাদের হিংসা হয়”, মিঃ নাজি বলছেন।

‘’এই বছর আমরা আসলে রমজান মাসে নেই, আমাদের হয়তো এর নাম পরিবর্তন করা উচিত। আমরা এখন আছি মৃত্যু মাসের মধ্যে।’’

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন মুয়াথ আল-খাতিব।


Spread the love

Leave a Reply